সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৪৫

মালয়েশিয়া থেকে আসে খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

মালয়েশিয়া থেকে আসে খুনি

সুপরিসর ফ্ল্যাট। বেডরুমের মেঝের ওপর পড়ে আছে লাশ। মুখে স্কচটেপ লাগানো। হাত-পা শেকলে বাঁধা। বেশ কয়েক দিন হয়ে গেছে। ফুলে-ফেঁপে গেছে পুরো শরীর। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। নাকে মাস্ক লাগানো পুলিশ কর্মকর্তারা লাশটি উল্টে-পাল্টে দেখছেন। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করছেন। গলায় জমাট বাঁধা রক্তের দাগ। পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। একজন বলছেন, ‘অপহরণ করে নিয়ে এসে লোকটিকে হত্যা করা হতে পারে। আর খুনটা যে পরিকল্পিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পেটানোর পর লোকটিকে সম্ভবত শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’

রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণির চতুর্থতলার ফ্ল্যাট থেকে শেকল বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে লাশটি উদ্ধারের পর তার পরিচয় শনাক্ত করতে মাঠে নামে গোয়েন্দারা। ওই বাসার মালিক থাকেন কলাবাগানে। মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ডিসেম্বরেই বাসাটি ভাড়া করেন। ১৯ ডিসেম্বর তিনি ওই বাসায় ওঠেন। ৩১ ডিসেম্বর পুলিশ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে লাশটি উদ্ধার করে। পুলিশ নিশ্চিত হয়, খুনের জন্যই বাসাটি ভাড়া করে দুর্বৃত্তরা।

গোয়েন্দারা রাজধানীর প্রতিটি থানায় লাশ উদ্ধারের মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, এমন কোনো তথ্যের জন্যই এই মেসেজ পাঠানো। তাহলে লাশটি দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু পুলিশ এ ধরনের কোনো তথ্য পেল না। লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। পত্র-পত্রিকায় পরদিন অজ্ঞাত এই ব্যক্তির লাশের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি ফ্ল্যাটে শেকলে বাঁধা এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের সংবাদটি সারা দেশে আলোচিত হয়।

পরে পুলিশ লাশটির পরিচয় পায়। তিনি হলেন রমনা থানা জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ইসহাক। তাকে খুন করতে মালয়েশিয়া থেকে দুই খুনিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। খুন শেষে তারা আবারও ফিরে যায় মালয়েশিয়ায়। পুলিশ এই দুই খুনি বাদে অন্য ৩ আসামিকে পাকড়াও করতে সমর্থ হয়।

লাশ উদ্ধার : লোকজনের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ মধ্যরাতে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণির ১৪৯/এ নম্বর বাড়ি নর্দান নিরালয় অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থতলায় যায়। এ সময় ফ্ল্যাটটি বাইরে থেকে তালা লাগানো ছিল এবং দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। পুলিশ ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। ভিতরে ঢোকার পর মেঝেতে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ। তার মুখে স্কচটেপ লাগানো এবং হাত-পা শেকল দিয়ে বাঁধা। পরে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।

এই ফ্ল্যাটের মালিক কলাবাগানে থাকেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মাসুদ রানা পরিচয়ে এক ব্যক্তি বাড়ির কেয়ারটেকার আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। সে সময় মাসুদ কেয়ারটেকারকে জানান, কানাডা থেকে তার বোন-দুলাভাই এসে এই ফ্ল্যাটে থাকবেন। ১৯ ডিসেম্বর মাসুদ ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু নিহত এই ব্যক্তিকে তিনি চেনেন না। পাঁচ দিন ধরে ওই ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ ছিল। পরে দুর্গন্ধ বের হলে স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়। এ ব্যাপারে পুলিশ মামলা করেছে। মাসুদ খুন করতেই ছদ্মনামে এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিকে বাইরে থেকে এনে হত্যা করার পর সে বাইরে দরজায় তালা মেরে পালিয়ে যায়, পুলিশের ধারণা এরকমই। পুলিশ জানায়, ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর ইমাম মো. ইসহাককে অপহরণ করা হয়। রমনা এলাকা থেকে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। সেখান থেকে সোজা শেওড়াপাড়ার ফ্ল্যাটে। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। পরে পত্রিকার মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা এক লাশের খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ইসহাকের লাশ শনাক্ত করেন তার ভাই শুয়াইব। পরে তিনি অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে প্রতিবেদন পেশ করে।

মামলার বিচার : মাওলানা ইসহাক হত্যার দায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন এ রায় দেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন আবদুর রহিম সরদার (৪৩), কাজী বায়েজীদ (৪২), ইকরাম খান ওরফে মাসুদ ওরফে নাঈম খান (৪৫) ও মুরাদ হোসেন (৪৫) এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন মো. নাজিমুদ্দিন (৪০)।

কারাগারে আটক আসামি আবদুর রহিম সরদার, কাজী বায়েজীদ, মো. নাজিমুদ্দিনের (৪০) উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। আসামি ইকরাম খান ওরফে মাসুদ ওরফে নাঈম খান ও মুরাদ হোসেন মামলার শুরু থেকেই পলাতক। তারা মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান।

পুলিশি তদন্তে জানা যায়, ইমাম ইসহাকের আত্মীয় ইলিয়াস মোল্লা চট্টগ্রামে তার লবণের কারখানা আবদুর রহিমের কাছে বিক্রি করেন। মূল্য পরিশোধ করা সত্ত্বেও ইলিয়াস কারখানা রেজিস্ট্রি করে না দিলে এতে আপসের চেষ্টা করেন ইমাম ইসহাক। তিনি নিজেও রহিমের কাছে টাকা পেতেন।

লবণ ফ্যাক্টরির মধ্যস্থতা ও ইমাম ইসহাকের পাওনা টাকা না দেওয়ায় তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ চরম আকার ধারণ করলে মালয়েশিয়া প্রবাসী আবদুর রহিম ইমাম ইসহাককে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মতে ভাড়াটে খুনি ইকরাম ওরফে মাসুদ ও মুরাদ হোসেনকে মালয়েশিয়া থেকে দেশে পাঠায়। তারা বায়েজীদ ও নাজিমুদ্দিনের সহায়তায় ইমাম ইসহাককে অপহরণের পর হত্যা করেন।

ইন্টারপোলের রেড নোটিস : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা ইসহাক হত্যার পরিকল্পনাকারী মালয়েশিয়া প্রবাসী ও ঘাতক ইকরাম হোসেন নাঈম এবং মুরাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের সদস্যভুক্ত ১৮৮ দেশে রেড নোটিস পাঠিয়েছে।

সর্বশেষ খবর