মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মেয়র নাছিরের পদ আছে পতাকা নেই

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

মেয়র নাছিরের পদ  আছে পতাকা নেই

আ জ ম নাছির উদ্দিন

সামনে নির্বাচন। আসছে অশনি-সময়। এমনিতেই বহুধাবিভক্ত বন্দর চট্টগ্রামের রাজনীতি। তার ওপর সমন্বয়হীন উন্নয়ন, অগ্রাধিকার নিশ্চিতে ব্যর্থতা, হালে নতুন করে হোল্ডিং ট্যাক্সের চাপ— সব মিলিয়ে সরকারের অর্জনে যেন পড়েছে কর্ণফুলীর ভাটার টান। এমন অবস্থায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সিংহভাগ আসনে জয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাম্য প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্যেই ঢাকার দুই মেয়রের মতো চট্টগ্রাম সিটি মেয়রকেও মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের ধারণা, পদ থাকলেও পতাকা না থাকায় চট্টল রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে অসম প্রতিযোগিতা। খোদ নিজ দলের সভাপতি প্রবীণ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীই প্রকাশ্য বিরোধিতা করছেন মেয়র নাছিরের। এরই মধ্যে উন্নয়নে ঘুষ উেকাচের অভিযোগ তোলা হয়েছে মেয়র যেন বেকায়দায় পড়েন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বরাদ্দে অপ্রতুলতা, চসিকের চেয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রকল্প বরাদ্দে অগ্রাধিকারসহ নানা ঘটনাকে আমলাতান্ত্রিক আক্রোশ বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। অন্যদিকে মেয়র হওয়ার পর নগরজুড়ে বিলবোর্ড উচ্ছেদে সাফল্যের পর ‘ডোর টু ডোর’ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম যখন সাফল্যের পথে, তখন হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন খোদ ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীরা। এসব বিতর্কের কারণে দল গোছানোর প্রক্রিয়া পিছিয়েই পড়ছে। এ কারণে আসন্ন নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহানগরে প্রশ্নবিদ্ধ হবে আওয়ামী লীগ। শহরে ছয়টি আসনেই (দুটি আংশিক) চরম বেকায়দায় পড়তে হতে পারে ক্ষমতাসীন দলকে। এমন আশঙ্কা কাটাতে মেয়র নাছিরকে শুধু পদ নয়, মন্ত্রীর পতাকা দিয়ে দলে ও প্রশাসনে অবস্থান আরও সুসংহত করার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তার সমর্থকরা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের মতো মেয়র নাছিরের মন্ত্রীর পদমর্যাদার দাবি ওঠে মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের বছরপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশেও। অবশ্য পদমর্যাদা বা স্ট্যাটাস পাওয়াটা ‘মুখ্য বিষয় নয়’ বলে মন্তব্য করেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। একসময় ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র অভিন্নভাবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। আর এখন ঢাকার দুই মেয়র পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা পেলেও চট্টগ্রামের মেয়রকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা না দেওয়ায় চাপা ক্ষোভের বিস্তার ঘটছে ৬০ লাখ মানুষের নগরী চট্টগ্রামে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, এমনকি বিরোধী শিবিরেও চাপা অসন্তোষ রয়েছে বলে জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিক্ষাবিদ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সমাজকর্মী, সংগঠকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অভিন্ন দাবি, ‘চট্টল মেয়রকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হোক।’ উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বছর না পেরোতেই ঢাকার দুই মেয়র পান মন্ত্রীর মর্যাদা। নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভিকেও উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু তা অধরা রয়ে যায় চট্টগ্রামের। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের প্রথম মনোনীত মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়।  বিএনপি মনোনীত সাবেক মেয়র মীর নাছির উদ্দিনও মেয়র থাকাকালে  প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন। এদিকে ঢাকা শহরকে দুই ভাগ করার পর অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে বিজয়ী দুই মেয়রকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের পূর্ণ শহরের মেয়রকে এখনো সেই স্বীকৃতি না দেওয়াটা চট্টগ্রামের প্রতি ‘বৈষম্য’ই বলে মনে করছেন সচেতনরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজেই নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে বাণিজ্যিক রাজধানীর মেয়রের প্রতি বঞ্চনাকে ‘স্ববিরোধিতা’ বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। এমনিতেই চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিএনপি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিতে চট্টগ্রামে বিএনপি আন্দোলনের দানা বাঁধার ভিত্তি তৈরি করছে এখন।

বিএনপি মনোনীত সাবেক মেয়র ও প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনও ক্ষমতাসীন দলের অনৈক্যে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, মন্ত্রীর মর্যাদা বণ্টনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের প্রতি শুধু বঞ্চনা নয়, চট্টগ্রামের মেয়রের এখন আর আগের মতো উন্নয়ন ও সমন্বয় কাজে প্রধান নিয়ন্ত্রকের পূর্ণ ক্ষমতা নেই। আগে অন্য সেবা সংস্থাগুলোর একজন করে প্রতিনিধি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় অফিশিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে অংশ নিতে বাধ্য থাকতেন। সেই নিয়ম তুলে নিয়ে চসিক মেয়রের ক্ষমতাকে আগেই খর্ব করা হয়েছে বলেও জানান মীর নাছির। চট্টগ্রামের প্রথম মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মেয়রের মর্যাদা প্রশ্নে বলেছেন, ‘বিষয়টি বৈষম্যই। মেয়র যেহেতু নগরপিতা, সেহেতু মেয়রকে সম্মান জানালে নগরবাসীই সম্মানিত হবেন। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জসহ একাধিক শহরের মেয়রকে যেখানে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেখানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের মেয়রকে উপেক্ষা করা সঠিক কাজ নয়।’ এদিকে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (সিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলমও মনে করেন, মেয়রের মন্ত্রীর পদমর্যাদা প্রত্যাশিত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. বেণু কুমার দে বলেন, ঢাকার আগেই চট্টগ্রামের মেয়রের মর্যাদাটি দেওয়া উচিত ছিল। কেননা ঢাকাকে দুই ভাগ করে দুটি করপোরেশনে দুজনকে মেয়র করা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম এখনো অখণ্ড শহর, মেয়র একজনই। পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রামের সভাপতি প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, মর্যাদাটি ব্যক্তি আ জ ম নাছির উদ্দিনের নয়, পুরো প্রতিষ্ঠান তথা চট্টগ্রামের। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু বলেন, মন্ত্রিত্ব বড় কথা নয়, চট্টগ্রামের সম্মান বড় কথা। মেয়রকে যোগ্য মর্যাদা না দিয়ে কার্যত চট্টগ্রামকেই অপমান করা হয়েছে বলে মনে করেন এই নাট্যজন।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এখনই চট্টল মেয়রকে পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া না হলে মাঠের রাজনীতিতে ভুগতে হবে আওয়ামী লীগকে।

সর্বশেষ খবর