বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

লালনে মাতোয়ারা আখড়াবাড়ি

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

লালনে মাতোয়ারা আখড়াবাড়ি

কেউ কলার পাতায়, আবার কেউ থালায় ভাত, ডাল ও মাছ নিয়ে ঠায় বসে আছেন। কেউ খাবার মুখে তুলছেন না। বেলা সাড়ে ১২টায় লালন আখড়াবাড়ির আঙিনায় সারিবদ্ধভাবে বসে থাকা হাজার হাজার সাধু গুরু বাউলের মধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। কিন্তু অগণিত বাউলের মধ্যে খাবার পরিবেশন শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে তখন প্রায় আড়াইটা। সবাইকে খাবার পরিবেশন শেষ হলে লালন মাজারের খাদেম মাইকে উচ্চারণ করলেন, ‘আল্লাহ আলেক’ তখন সবাই একসঙ্গে খাবার মুখে তুললেন। গতকাল দুপুরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় মরমী সাধক ফকির লালন সাঁই-এর ১২৭তম তিরোধান দিবসের উৎসবের এ ঘটনা। এমন আত্মসংযোগ অর্জন হয়তো কেবল লালন ভক্ত নির্লভ এ মানুষগুলোর পক্ষেই সম্ভব। গত সোমবার থেকে বাউল সাধু বৈষ্ণবদের মেলা বসেছে লালনধামে। ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত ভুলে তারা গাইছেন মানুষের জয়গান। সোমবার সন্ধ্যায় এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও তার অনেক আগেই মানুষের মিছিল আসতে শুরু করে এই বাউল তীর্থে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউলেরা ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। তারা বাউল তীর্থে এসে ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’, ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর— এ রকম অসংখ্য লালনসংগীতের সুরের মূর্ছনায় চারদিক মাতোয়ারা করে তুলেছেন। তারা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন তার গাওয়া গান গেয়ে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। ভাবগান আর বাউল আচারের যজ্ঞ পালন ছাড়াও বাউল পথ ও মতের দীক্ষাও নিচ্ছেন অনেকে। আখড়ায় কথা হয় দৌলতপুরের বাউল ফজল শাহের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সহজ মানুষ খোঁজা আর ভজার কাজে দীক্ষা নিয়েছি। এই পথেই সারা জীবন কাটাতে চাই’। ফরিদপুরের বাউল নিজাম শাহ বলেন, ‘চোখে দেখা মানুষকে যদি ভালোবাসতে না পারি তবে অদেখা আল্লাহকে ভালোবাসব কী করে। মানুষকে ভালোবাসলেই খোদার দেখা মিলবে। তাই তো সাঁইজির পথে দীক্ষা নিয়েছি।’ লালন উৎসবে এসেছিলেন রাজবাড়ী জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক লালন গবেষক ড. আজাদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকের সমাজ ব্যবস্থায় হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু লালন অনুসারীরা আজও এসব থেকে নিজেদের সংযত রাখতে পেরেছে। তারা কারও মাথায় লাঠি মারে না, কোনো অনৈতিক কাজেও জড়ায় না। এক সময় লালন অনুসারীরা নিজেদের মতো করে বছরে দুবার আখড়া বাড়িতে এসে সাঁইজিকে স্মরণ করতেন। পরে লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। লালনের গানের আদি সুর সংরক্ষণ, লালন ভক্তদের স্বার্থ সংরক্ষণে লালন একাডেমি কতটা কাজ করতে পারছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বাউল। বর্তমানে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত বাউল মুক্তিযোদ্ধা নইর শাহ বলেন, ‘লালন একাডেমির তো কোনো কাজ নেই। তারা বছরে দুবার মেলার মাঠ ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। এই টাকার অতি সামান্য অংশই লালন অনুসারীদের জন্য খরচ হয়। যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের আগে সাঁইজির পথে দীক্ষা নিতে হবে, নইলে তারা বাউলদের সুখ-দুঃখের সাথী হবে কী করে?’ আজ (বুধবার) শেষ হবে তিন দিনের এই মিলনমেলা। আপন আপন ঠিকানায় ফিরে যাবেন বাউলরা। আবার দিন গুনতে থাকবেন আগামী দোল উৎসবের জন্য।

সর্বশেষ খবর