বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আলমাছ বাহিনীর কাছে জিম্মি রূপগঞ্জবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান সজীবকে হত্যার চেষ্টাকারী রূপগঞ্জের আলমাছ বাহিনীর প্রধান আলমাছ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আলমাছের ক্ষমতার উৎস জানতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর নব তথ্য বেরিয়ে আসছে। 

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া রাসেল পার্কের মালিক শিল্পপতি রাসেল হত্যা মামলার অন্যতম ফাঁসির আসামি মুড়াপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছ বাহিনীর কাছে জিম্মি এলাকার সাধারণ মানুষ। কূটকৌশলে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে চেয়ারম্যান হয়ে ফের খুন, সন্ত্রাস, রাহাজানিতে মেতে উঠেছেন তিনি। আলমাছ বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসীসহ স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চেয়ারম্যান আলমাছের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা গুরুতর অভিযোগ। চাঁদাবাজি, ভূমি জবর দখল, কৃষকের কৃষি জমি থেকে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকার মাটি বিক্রিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে এ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এলাকায় হত্যা চেষ্টা, মাদক ব্যবসা, জমি দখল ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন এই আলমাছ। চেয়ারম্যান আলমাছ এখন মুড়াপাড়া ইউনিয়নসহ রূপগঞ্জের মূর্তিমান আতঙ্ক বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এক সময়ের বিএনপি নেতা চেয়ারম্যান আলমাছ এখন মুড়াপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকায় সপ্তাহ খানেক আগে আলমাছ বাহিনী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান সজীবকে হত্যাচেষ্টা চালায়। সে যাত্রায় বেঁচে যান সজীব। আর এ ঘটনায় এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়নের মাছিমপুর এলাকার নসুর উল্লাহ মুন্সীর ছেলে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আলমাছ এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মুড়াপাড়া ইউনিয়নসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা, জমি দখল ও চাঁদাবাজিসহ কৃষকের ফসলি জমির মাটি জোরপূর্বক কেটে ইটভাটার মালিকদের কাছে বিক্রি করেই বিত্তশালী হয়েছেন আলমাছ। এলাকাবাসী জানায়, পান থেকে চুন খসলেই আলমাছ বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দিয়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। আলমাছের রয়েছে অস্ত্রসহ নিজস্ব বাহিনী। তার চারজন দেহরক্ষী রয়েছে যাদের রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। এক সময়ের ত্রাস আলমাছ এখন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রয়াত জামাল হাজীর ছেলে মুড়াপাড়া কলেজের ভিপি খালেদের হাত ধরে আলমাছের উত্থান ঘটে। খালেদ বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আলমাছ চেয়ারম্যান। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ খালেদের সব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন আলমাছ। ১৯৯১ সালে খালেদ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। সে সময় জামাল হাজীর পরিবার খালেদকে হত্যার পেছনে উপজেলার মাহমুদাবাদ এলাকার শিল্পপতি ও রাসেল পার্কের মালিক রাসেল ভূঁইয়া জড়িত ছিলেন বলে মনে করত।

২০০০ সালে দিনদুপুরে রাসেল পার্কের ভিতরে প্রকাশ্যে রাসেল ভূঁইয়াকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত রাসেল ভূঁইয়ার স্ত্রী জাকিয়া ভূঁইয়া সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছ। ওই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আসামিদের ফাঁসির আদেশ দেয়। উচ্চ আদালতে আপিল করে বিভিন্ন কলাকৌশল খাটিয়ে সাজা খেটে খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। পরে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এরপর বেশ কয়েক বছর তোফায়েল আহমেদ আলমাছ চেয়ারম্যান পর্দার আড়ালে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, মাছুমাবাদ এলাকার মিছির আলী ও তার ছেলে, ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার মতি, মাছিমপুর এলাকার বাবু ও তার পিতা জালাল, শওকত, মঙ্গলখালীর জাহাঙ্গীর, সর্বশেষ শ্রমিকলীগ নেতা তারা মিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আলমাছ জড়িত। এদের অধিকাংশই আলমাছের অধীনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। আর এসব হত্যাকাণ্ডে আলমাছ এক ঢিলে দুই পাখি মারত। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর নিজে নির্দোষ থাকতে বাদীকে দিয়ে তার প্রতিপক্ষের লোকজনকে ফাঁসিয়ে দিত। কিছু দিন আগে তারই ওস্তাদ প্রয়াত বিএনপি নেতা হাজী জামালের ছোট ছেলে হাসিব বিন জামালের কাছ থেকে হাউজিং ব্যবসার নামে ৩০০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে বলে সূত্র জানায়। সেই টাকা দিয়ে আলমাছ চেয়ারম্যান উপজেলার আমলাব এলাকায় নিজেই হাউজিং করছে। আলমাছ বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছে এজাজ আহমেদ নামে এক সন্ত্রাসী। তার নামে বহু অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।

২০০৪ সাল থেকে তোফায়েল আহমেদ আলমাছ বিভিন্ন মিল কারখানার মালিকদের জমি জবরদখলের কাজে সহযোগিতা শুরু করেন। চুক্তির ভিত্তিতে জমি জবরদখল করে দিতেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। গত পৌর নির্বাচনের আগে মেয়র প্রার্থীর সমর্থন নিয়ে স্থানীয় এমপি গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়ার বিরোধ দেখা দেয়। ওই বিরোধের সুযোগে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তোফায়েল আহমেদ আলমাছ চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। আর নানা কলা কৌশলে তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়লাভ করানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই আলমাছ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে পদাধিকার বলে মুড়াপাড়া বাজার কমিটির সভাপতি হন তিনি। বাজার কমিটির সভাপতি হয়ে তিনি তার ভাই জয়নাল মুন্সীকে বাজারের সহসভাপতি ও দুলাল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করেন। এরপর বাজারে শুরু হয় লুটপাট। নতুন দোকান ঘর বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে অর্ধকোটি টাকা। বাজার কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত শিকদার জানান, গত পাঁচ বছরে মুড়াপাড়া বাজারে দোকান মালিকদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। বর্তমান বাজার কমিটির সভাপতি চেয়ারম্যান আলমাছ নতুন করে ৭০টি দোকান ঘর নির্মাণ করে বরাদ্দের নামে প্রত্যেক দোকান মালিকের কাছ থেকে ৩০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া বাজার কমিটির সহসভাপতি তার ভাই জয়নাল মুন্সী ও সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন মিলে মূল দোকান মালিকদের দোকান না দিয়ে তাদের নিজ নামে ও আত্মীয়দের নামে দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক বছর আগে শ্রমিকলীগ নেতা তারা মিয়াকে হত্যা করে আলমাছ বাহিনী। সর্বশেষ হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপজেলার দড়িকান্দি এলাকায় অবস্থিত আশমিনা ফেব্রিক্স প্রা. লি. নামে একটি কারখানার ২ দশমিক ৩৪ একর জমি দখল নিতে জোরপূর্বক বালু ভরাট করেছে চেয়ারম্যান আলমাছ। এ ঘটনায় জমির মালিক মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, রূপগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখতে আলমাছ বাহিনীর লোকজন এলাকায় প্রকাশ্যে শটগান নিয়ে ঘুরাফেরা করে। এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে আলমাছ চেয়ারম্যান অবাধে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে আলমাছ বাহিনী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাফিজুর রহমান সজীবকে হত্যাচেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এ ব্যাপারে তোফায়েল আহমেদ আলমাছ জানান, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর