শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পঞ্চগড়ে বদলে গেছে জীবনযাপন

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

পঞ্চগড়ে বদলে গেছে জীবনযাপন

দেশের সর্ব-উত্তরে ভারতীয় সীমান্তবেষ্টিত ছোট জেলা পঞ্চগড়। মাত্র কয়েক বছরে বদলে গেছে এখানকার জীবনমান। এখন এখানকার উৎপাদিত ধান, চা, কমলা, বাদাম, মরিচ, টমেটো, বেগুন, শিম, পানসহ নানান শাক-সবজি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে যেখানে মানুষের ‘কাজ ছিল না’ অবস্থা ছিল, এখন সেখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের কর্মচঞ্চলতা তৈরি হয়েছে। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো জানায়, মাত্র দুই দশক আগে এই জেলায় ভাদ্র থেকে কার্তিক ছিল ভয়াবহ দুঃসময়। অভাবের তাড়নায় মানুষ দুই বেলা শুধু কচু সিদ্ধ করে খেয়েই পার করে দিতেন দিনের পর দিন। কাজের খোঁজে পাড়ি জমাতেন দেশের নানা প্রান্তে। ভালো বাড়ি, সুন্দর পোশাক-আশাক ছিল তাদের জন্য অনেক দূরের স্বপ্ন। কেরসিনের অভাবে সন্ধ্যা বেলাতেই চেরাগ নিভে যেত। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো তাদের। পায়ে হেঁটে অথবা কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর গ্রামের মানুষকে কোনো রকমে বাসে উঠে যেতে হতো অফিস বা শহরে। কাজের অভাবে চৌরাস্তার মোড়ে কেটে যেত সারাদিন। কাজহীন অলস সময়গুলো বড় দুঃসহ ছিল তাদের জন্য। কিন্তু সেই মানুষই এখন পুরো ব্যস্ত। অতীতের দিকে ফিরে তাকানোরও যেন সময় নেই তাদের। নিজেদের পরিশ্রম আর কাজের সুযোগ তাদের জীবনে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। খরের চালের ঘর আর মাটির বাড়ির বদলে উঠেছে ইট সিমেন্টের ঘর। গ্রামগঞ্জে কমে গেছে কাঁচা রাস্তা। তার বদলে পাকা রাস্তায় ছুটছে অটো ভ্যান, অটো বাইক। বাড়ি ফেরা যাচ্ছে গভীর রাতেও। যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যাওয়া যাচ্ছে যখন খুশি তখন।

পঞ্চগড়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র বলছে, চলতি বছর ৩০ হাজার ১১৪ হেক্টর জমিতে আবাদ করে কৃষকেরা টমেটো উৎপাদন করেছে ৯৭ হাজার ১৯৩ মেট্রিক টন। এর অধিকাংশ হয়েছে সদর উপজেলায়। ১৭ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে হয়েছে ভুট্টার আবাদ। বোদা উপজেলার অধিকাংশ ভুট্টা উৎপাদনে জড়িত। ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়েছে জেলায়। দেশের অর্ধেক বাদামের চাহিদা পূরণ করছেন এই জেলার কৃষক। প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করে ১৯ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদন করা হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছর পঞ্চগড়ের লাল সোনা খ্যাত মরিচ উৎপাদিত হয়েছে ১৮ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। যা আটোয়ারী উপজেলার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ করে থাকেন। উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে এই এলাকার কৃষকের। জেলার মাটি ও আবহাওয়া দুটোই কৃষির জন্য উপযোগী। এখানে বহুমাত্রিক চাষাবাদ হয়। প্রায় সব ধরনের ফসল হয় । এই জেলার প্রতিটি বাড়িতেই এখন কমবেশি আম, লিচু, কমলাসহ নানা ফলের গাছ রয়েছে। নিজেদের গাছের ফল খেতে পারছেন তারা। কৃষিকাজ করেই তাদের ভাগ্য বদলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ৩৪টি নদী। ৪৬টি নদী এ জেলার ভূমি এবং মানুষকে সমৃদ্ধ করছে। চা বাগান আর ভূগর্ভস্থ পাথরও পাল্টে দিয়েছে তেঁতুলিয়া উপজেলার ৮০ ভাগ মানুষের জীবনমান। ভজনপুর এলাকার হবিবুর রহমান টিউবওয়েল মেরামতের কাজ করতেন। নিজের দুই বিঘা জমিতে হঠাৎ পাথরের সন্ধান পান তিনি। ভূগর্ভস্থ সেই পাথর তুলে আজ তিনি কোটিপতি। এরকম রয়েছে হাজারো উদাহরণ। এই উপজেলার অধিকাংশ নারীই এখন স্বাবলম্বী। উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য চলছে। দেশের নানা প্রান্তের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি প্রায় সহস াধিক ব্যবসায়ী এই বন্দরে ব্যবসা করে তাদের জীবন বদলে ফেলেছেন। বন্দর সংশ্লিষ্ট নানা কাজে জড়িয়ে আরও কয়েক হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। এই বন্দর দিয়ে চীনের দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার।

বন্দর দিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের আলাপ-আলোচনা চলছে। বন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট স্থাপিত হওয়ার কারণে তিন দেশে যাচ্ছেন মানুষ। এ খাতেও আয় বেড়েছে। হ্যান্ডবলে তেঁতুলিয়ার নারী খেলোয়াড়রা বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছেন। জেলার অধিকাংশ বাড়িতে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ।

পঞ্চগড় পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক ইউনুস আলী জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আটোয়ারী উপজেলায় শতভাগ; বোদা, দেবীগঞ্জ ও সদর উপজেলায় ৮০ ভাগ এবং তেঁতুলিয়া উপজেলায় ৭০ ভাগ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া অধিকাংশ বাড়িতে রয়েছে সোলার সিস্টেম। জেলার ৭০ ভাগ রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। ফলে বেড়ে গেছে যোগাযোগের গতি। অধিকাংশ বাড়িতেই রয়েছেন শিক্ষিত মানুষ। বাড়ছে শিক্ষার হার। জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪ শতাংশ। এখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকলেও কোন্দল বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই বললে চলে। গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাজার। গুরুত্বপূর্ণ কাজ না থাকলে শহরে যান না কেউ। গ্রামেই পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেট। গ্রামে বসেই কম্পিউটার ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন সবাই। ওয়াকিবহালরা বলছেন, এসব কারণে পঞ্চগড় জেলার মানুষের জীবন মানে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। আধুনিক জীবনযাপন এখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সমতলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জেলা দেখতেও ছুটে আসছেন পর্যটকরা। তবে এখনো রয়েছে কিছু সমস্যা। ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন থামছে না। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। ভূপ্রকৃতি গবেষকরা মনে করছেন, ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন চলতে থাকলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর