শিরোনাম
শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
দুদকের অনুসন্ধান

কোচিং বাণিজ্যে ৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১১ শিক্ষক

মোস্তফা কাজল

প্রায় আট মাস অনুসন্ধান শেষে ৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১১ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে গতকাল ঢাকা বিভাগীয় দুদক অফিস থেকে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে রাজধানীর ৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মণিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল ও রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। অনুসন্ধান প্রতিবেদন গতকাল দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দফতরে জমা দিয়েছেন অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা। দুদক জানায়, কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রাজধানীর নয়টি নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১১ জন শিক্ষকের একটি তালিকা এখন দুদকের হাতে। এসব অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করেছে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়।

কমিশনে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে রাজধানীর নয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল শাখার ৩২ জন ও বনশ্রী শাখার চারজনসহ মোট ৩৬ জন, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৪ জন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ১২ জন, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের আটজন ও রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচজনসহ মোট ১১১ জন শিক্ষককে চিহ্নিত করেছে দুদক। জানতে চাইলে দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন বলেন, দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এখন যাচাই-বাছাই করা হবে। এরপর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও টিমপ্রধান মোহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘অনুসন্ধান করে তথ?্য-প্রমাণসহ একটি প্রতিবেদন গতকাল দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না হলেও যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২ করা হলেও কোচিং বন্ধে কোনো আইন হয়নি। সুনির্দিষ্ট আইনের আলোকে শাস্তির বিধান না রাখলে চূড়ান্তভাবে কোচিং বন্ধ করা কঠিন। ফলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কোচিং বাণিজ্য রোধে এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে, এক শাখা থেকে অন্য শাখায়, দিবা শিফট থেকে প্রভাতী শিফটে বা প্রভাতী শিফট থেকে দিবা শিফটে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বদলির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা যেতে পারে। অন্যদিকে একই দিন ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ ও রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিযান চালায় দুদকের দুটি টিম। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, এ প্রতিষ্ঠান দুটোতেও একই চিত্র দেখা গেছে। তবে এ দুটো স্কুলের প্রধান শিক্ষক কোচিংয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তা বিভিন্ন সময়ে মিটিং বা নোটিস আকারে শিক্ষকদের দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক এসব নির্দেশনা অমান্য করে কোচিং বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছেন বলে দুদককে তারা জানিয়েছেন। অভিযানকালে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাঁচ শিক্ষককে হাতেনাতে নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং করানো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

 ওই পাঁচ শিক্ষক হলেন— ইংলিশ মিডিয়ামের গণিতের শিক্ষক এ বি এম মইনূল ইসলাম ও মো. আলী আকবর, বাংলা মিডিয়ামের গণিতের শিক্ষক মো. রেজাউর রহমান, বাংলা মিডিয়ামের ইংরেজির শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম ও  রসায়নের শিক্ষক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। কমিশনে দেওয়া প্রতিবেদনে তাদের নাম যোগ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে লিখিতভাবে ছাত্রছাত্রীর নাম ও রোল নম্বরসহ তালিকা জানাতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ওই ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজনকে পড়ালেও তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এমনকি কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারবেন না। শাস্তির বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্ত, এমপিওভুক্ত শিক্ষক হলে এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

দুদকের তালিকায় থাকা শিক্ষক : আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ— নিজাম উদ্দিন কামাল (ইংরেজি), আবদুল মান্নান (রসায়ন), উম্মে ফাতিমা (বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়), মো. আজমল হোসেন (বাংলা), গোলাম মোস্তফা (গণিত), আশরাফুল আলম (রসায়ন), বাবু সুভাষ চন্দ্র পোদ্দার (রসায়ন), লাভলী আখতার, তাসমিন নাহার, মতিনুর (ইংরেজি), উম্মে সালমা (ইংরেজি), মো. আবদুল জলিল (ব্যবসায় শিক্ষা), মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন (রসায়ন), মনিরা জাহান (ইংরেজি), ফাহমিদা খানম পরী (গণিত), লুত্ফুন নাহার (গণিত), হামিদা বেগম (গণিত), নাজনীন আক্তার (গণিত), উম্মে সালমা (ইংরেজি), তৌহিদুল ইসলাম (ইংরেজি), সুরাইয়া জান্নাত (ইংরেজি), মো. সফিকুর রহমান-৩ (গণিত ও বিজ্ঞান), মো. শফিকুর রহমান সোহাগ (গণিত ও বিজ্ঞান), নুরুল আমিন (গণিত), মনিরুল ইসলাম (ইংরেজি), রফিকুল ইসলাম (সমাজবিজ্ঞান), গোলাম মোস্তফা (গণিত), অহিদুজ্জামান (বাংলা), মাকসুদা বেগম মালা, আলী নেওয়াজ আলম করিম, মো. আবুল কালাম আজাদ ও মো. আবদুর রব এবং বনশ্রী শাখার মো. শফিকুল ইসলাম (ইংরেজি), মো. মাহবুবুর রহমান (পদার্থবিজ্ঞান), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (গণিত) ও আবদুল হালিম (গণিত)। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ—সহকারী প্রধান শিক্ষক এনামুল হক, মেজবাহুল ইসলাম (ইংরেজি), সুবীর কুমার সাহা (গণিত), মো. সাইফুল ইসলাম,  মোহনলাল ঢালী, বাসুদেব সমদ্দার, বকুল বেগম, আসাদ হোসেন (ইংরেজি), প্রদীপ কুমার বসাক, আবুল খায়ের, শারমীন খানম, মো. কবীর আহমেদ, খ ম কবির আহমেদ, মো. দেলোয়ার হোসেন, মাওলানা কামরুল হাসান, মো. রুহুল আমিন-২, মো. কামরুজ্জামান, শেখ শহীদুল ইসলাম, শুকদেব ঢালী, হাসান মঞ্জুর হিলালী, আমান উল্লাহ আমান, হামিদুল হক খান, রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও চন্দন রায়। খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়—সহকারী শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন চৌধুরী। মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক আবুল হোসেন মিয়া (ভৌতবিজ্ঞান), মো. মোখতার আলম, (ইংরেজি), মো. মাইনুল হাসান ভূঁইয়া (গণিত), মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (গণিত), মুহাম্মদ আফজালুর রহমান (ইংরেজি), মো. ইমরান আলী (ইংরেজি), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ কবীর চৌধুরী, এ বি এম ছাইফুদ্দীন ইয়াহ, মো. মিজানুর রহমান, মো. আবুল কালাম আজাদ, মো. জহিরুল ইসলাম ও সহকারী শিক্ষক মো. জামাল উদ্দিন বেপারী। মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়— প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষিক নূরুন্নাহার সিদ্দিকা (সামাজিক বিজ্ঞান), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক শাহ মো. সাইফুর রহমান (গণিত), মো. শাহ আলম (ইংরেজি), মোসা. নাছিমা আক্তার (ভূগোল)। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ—প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার চৌধুরী (ইংলিশ ভার্সন), ড. ফারহানা (পদার্থবিজ্ঞান), সুরাইয়া নাসরিন (ইংরেজি), লক্ষ্মী রানী, ফেরদৌসী ও নুশরাত জাহান। মণিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ—প্রভাতি শাখার সহকারী শিক্ষক যোবায়ের মাহমুদ (গণিত), মো. নুরুদ্দিন (গণিত), মো. মেহেদী হাসান (গণিত), শহীদুল ইসলাম (ইংরেজি), তুহিনুর রহমান (রসায়ন), ফেরদৌস হাসান (ইংরেজি), শামসুন্নাহার (বাংলা), মো. মাছুদ আলম, (ইংরেজি), দিবা শাখার সহকারী শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন (ইংরেজি), মো. মোখলেছুর রহমান (গণিত), মো. নূরুজ্জামান (রসায়ন), মো. সাইফুল্লাহ (ইংরেজি), তাজুল ইসলাম (বাংলা) ও সহীদুর রহমান বিশ্বাস (ইংরেজি)। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল—মো. শাহজাহান সিরাজ (গণিত), মোহাম্মদ ইসলাম (গণিত), জাকির হোসেন (গণিত), মো. শাহজাহান (গণিত), মো. আবদুল ওয়াদুদ খান (সামাজিক বিজ্ঞান), মো. আলতাফ হোসেন খান (ইংরেজি), মো. আযাদ রহমান (ইংরেজি) ও রণজিৎ কুমার শীল (গণিত)। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ—এ বি এম মইনুল ইসলাম (গণিত), মো. আলী আকবর (গণিত), মো. রেজাউর রহমান (গণিত), মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম (ইংরেজি) ও মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (রসায়ন)।

সর্বশেষ খবর