রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্ভোগের শেষ নেই রোহিঙ্গাদের

ত্রাণ ও আবাসন সংকট ঝড়ে লণ্ডভণ্ড তাঁবু

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

দুর্ভোগের শেষ নেই রোহিঙ্গাদের

উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে খাবারের জন্য হাহাকার থামছেই না —এএফপি

উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দুর্ভোগ লেগেই আছে। মিয়ানমার থেকে দুই মাসে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার নানামাত্রিক দুর্ভোগ ও সংকট যেন পিছু ছাড়ছে না। ঝড়-বৃষ্টি, খাদ্য-চিকিৎসা ও আবাসন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। গত তিন দিন ধরে মিলছে না তেমন ত্রাণ সহায়তাও। তার ওপর যুক্ত হয়েছে টানা বৃষ্টিপাত ও ঝড়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ঝড়ের তোড়ে শুক্রবার রাত থেকে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পাহাড়চূড়ার শত শত রোহিঙ্গা তাঁবু। নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা এসব রোহিঙ্গা প্রতিমুহূর্ত পার করছে বিপদসংকুল পরিবেশে। ডায়রিয়া, হাম, পোলিও, যক্ষ্মা, রক্ত ও পানিশূন্যতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ঘুম এবং বিশ্রাম নিতে পারছে না বলেই এসব রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে বলে জানালেন এখানকার মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসকরা। রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা করতে দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝিরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, পালংখালী ও থাইংখালীর বিভিন্ন পাহাড়ি বনভূমিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তিন শতাধিক তাঁবু ঝড়ে ভেঙে গেছে। টানা বৃষ্টি ও বাতাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এসব তাঁবুর রোহিঙ্গারাসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হয়ে পড়েছে আশ্রয়হীন। অনেক তাঁবু কোনো রকমে দাঁড়িয়ে থাকলেও বৃষ্টির কারণে তাঁবুর মেঝেতে পানি জমে কাদা হয়ে যাওয়ায় সেখানে ঘুমানো তো দূরে থাক, বসার জায়গাটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে নির্ঘুম রাত ও দিন পার করছে অধিকাংশ রোহিঙ্গা। তার ওপর রয়েছে খাদ্য সংকট। প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশের কারণে কমে এসেছে ব্যক্তিগত ত্রাণ সহায়তা। সেই সঙ্গে কমে এসেছে এনজিওদের ত্রাণ সহায়তাও। এত দিন রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে  আসছিল এমন ৩০টির অধিক এনজিও ত্রাণ দিতে পারছে না। ত্রাণ সহায়তা প্রদানে টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের জন্য এনজিও ব্যুরোর কাছে এসব সংস্থা আবেদন জানালেও গত দুই সপ্তাহে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের ক্ষেত্রে সাধারণত এত দীর্ঘসূত্রতা হয় না। ফলে খাদ্যসহ ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব এনজিও এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসা এনজিও হেলপ ফর নিডির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সুজন খন্দকার জানান, দ্রুত এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন না মিললে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ ও সংকট কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কল্পনাতীত। শিগগিরই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল সচেষ্ট হয়ে এনজিও সংস্থাগুলোর ত্রাণ প্রদানে অনুমোদন না দিলে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। এদিকে গতকাল উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালংয়ের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ্রয়হীন হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে। খাদ্যের জন্য এক প্রকার হাহাকার শুরু হয়েছে। গাড়ি দেখলেই তারা ত্রাণের গাড়ি মনে করে ছুটে যাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ত্রাণ দিতে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নিরন্ন রোহিঙ্গারা। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক ধরে যেতে থাকা অভিজাতদের গাড়ি দেখলেই ছুটে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এদিকে আঞ্জুমানপাড়া থেকে ক্যাম্পে আনা প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গার অনেকেই গতকাল পর্যন্ত তাঁবু পায়নি, তাঁবু টাঙানোর জায়গাও পাননি অনেকে। ফলে গত বুধবার থেকে এখনো কোনোভাবে কারও তাঁবুতে আশ্রয় নিয়ে দিন পার করছে এরা। বৃষ্টির কারণে তারাও বেশ দুর্ভোগ-কষ্টে রয়েছে। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে তিন দিন থাকার পর ক্যাম্পে আসার অনুমতি মিললেও মিলছে না তাদের তাঁবু ও ত্রাণ সহায়তা। খেয়ে না খেয়ে আছে গত চার দিন। কুতুপালংয়ের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে বৃষ্টির মধ্যে মাথায় শুধু একটি পলিথিন ধরে বসে থাকা অবস্থায় কথা হয় মিয়ানমারের বুছিদং থেকে আসা মোহাম্মদ কালামের সঙ্গে। তার সঙ্গে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বসে আছে পরিবারের আরও চার সদস্য। এ সময় কালাম বৃষ্টি ও বাতাসের তোড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেন, ‘আঞ্জুমানপাড়া থেকে আসার সময় মনে করেছিলাম এখানে এলে তাঁবু মিলবে, থাকার জায়গা মিলবে, ত্রাণ ও মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা মিলবে। কিন্তু গত তিন দিনে দুই বেলা ভাত, একটি পলিথিন, কিছু বিস্কুট ছাড়া তেমন কিছু পাইনি। না খেয়েই আছি দুই দিন। কোথাও জায়গা পাচ্ছি না মাথা গোঁজার মতো। রাতেও ঘুমাতে পারছি না, দিনেও না।’ এদিকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে কক্সবাজার এলাকায় টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকাল দুপুরে বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা কমলেও সন্ধ্যায় আবার শুরু হয় প্রচণ্ড বৃষ্টি। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরও দুর্ভোগ বেড়ে যায়। বৃষ্টির কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগের দেওয়া ত্রাণের পরিমাণও কমে এসেছে। পুরনো কোনো কোনে রোহিঙ্গা পরিবারে পূর্বের সঞ্চিত কিছু ত্রাণ ও খাদ্য সামগ্রী থাকলেও নতুনদের তা নেই। বিশেষ করে নতুন করে আসা অর্ধলাখ রোহিঙ্গাকে গত তিন দিন ধরে ক্যাম্পে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে শিগগিরই সরকারি উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো হবে বলে জানান উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

রোহিঙ্গাদের মুনিরীয়া যুব তবলীগের ফ্রি চিকিৎসা : চট্টগ্রামের রাউজান কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার ও মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফ্রি চিকিৎসা ও ত্রাণসামগ্রী দিয়েছে। গতকাল কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী-২ খেলার মাঠে মিয়ানমার থেকে আসা ১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফ্রি ওষুধ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে। এরমধ্যে ছিল মশারি, হাতপাখা ও জায়নামাজ। পুরো কার্যক্রমের সমন্বয়ক ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর।

সর্বশেষ খবর