শিরোনাম
সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

থামছে না আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কাজ

সিদ্ধান্ত হয়, উচ্ছেদ করা হয় না

জিন্নাতুন নূর

থামছে না আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কাজ

রাজধানীর অনেক বহুতল আবাসিক ভবনেই বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে। মালিবাগ থেকে গতকাল তোলা ছবি — জয়ীতা রায়

রাজধানীর আবাসিক ভবনগুলো ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার চলছেই। আবাসিক ভবনের মালিকরা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তাদের ভবনের নিচতলা আবার কখনো গোটা ভবনই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। ভাড়াটেরাও বেপরোয়া। ‘বেআইনি কাজ’ জেনেও তারা আবাসিক ভবনে ব্যবসা করছেন। দুই পক্ষেরই টার্গেট মুনাফা। ফলত এসব ভবনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে হাসপাতাল, গার্মেন্ট কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সুপার শপ ইত্যাদি। আবাসিক এলাকার এমন ব্যবহারে তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে এসব এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর  কোনো কারখানা স্থাপনের অনুমতি নেই। তবু ওই ধরনের কারখানা সেখানে। আবাসিক ভবনের বহুমুখী বাণিজ্যিক ব্যবহারের ফলে সেই ভবনের বাসিন্দাসহ তার আশপাশের বাড়িগুলোর দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়ছে। ঢাকার উন্নত ও অনুন্নত এলাকা এমনকি যেসব এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাস সেখানেও এখন আবাসিক ভবন ব্যবহূত হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস ভবন হিসেবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আবাসিক ভবনেই গড়ে উঠছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো বাড়িতে আছে জুতা, হার্ডওয়্যার, কসমেটিক্স ও ব্যাটারিসহ বিভিন্ন পণ্যের কারখানা। যেখানে পণ্য তৈরিতে ব্যবহূত হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মালিকরা মোটা অঙ্কের ভাড়া পাওয়ার লোভে আবাসিক ভবনে খুলতে দিয়েছেন খাবার দোকান, মুদি দোকান, ফ্লেক্সিলোডের দোকান, ফার্মেসি, টেইলার্স, বিউটি পারলার, তৈরি পোশাকের দোকান, সেলুন, জিমনেশিয়াম, লাইব্রেরি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য মেরামতের দোকান এবং লন্ড্রি। কিছু ভবনের ছাদে আবার মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার ও বিলবোর্ড বিপজ্জনকভাবে বসানো। এ ছাড়াও এসব ভবনে ্ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে কোচিং প্রতিষ্ঠান। কিছু ভবন আবার বিভিন্ন এনজিও, ট্রাভেল এজেন্সি এবং আইটি প্রতিষ্ঠানকে ঠাঁই দিয়েছে। কয়েকজন বাড়ি মালিকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, আবাসস্থল হিসেবে দিলে যে ভাড়া পাওয়া যাবে তার থেকে অনেক বেশি পাওয়া যাবে যদি তা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। কাজেই ...। বানানোর সময় বাড়ির সামনে এক চিলতে খোলা যে জায়গা রাখা হয়েছিল বাড়তি ভাড়ার লোভে সেখানেও মালিকরা ছোট ঘর বানিয়ে ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিচ্ছেন। গাড়ি রাখার জন্য যেসব মালিক বাড়িতে গ্যারেজ বানিয়েছিলেন তারাও এখন নিজেদের গাড়ি অন্য কোথাও রেখে গ্যারেজটি দোকানদারদের ভাড়া দিচ্ছেন। গুলশান লিংকরোড, বাড্ডা, শান্তিনগর, মিরপুর-১০ ও পল্লবীসহ বিভিন্ন এলাকার সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর অর্ধেক ভবনই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। পরিবেশবিদরা জানান, একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার জন্য দরকার ফায়ার স্টেশন, কমিউনিটি সেন্টারসহ প্রয়োজনীয় বেশ কিছু স্থাপনা। কিন্তু এগুলোর বদলে এখন অপ্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক স্থাপনায় ভরে যাচ্ছে আবাসিক এলাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি শহরের একটি চরিত্র থাকে। সেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে আবাসিকের স্থলে বাণিজ্যিক কাঠামো তৈরি করা হলে মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে না। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। খেলার মাঠের অভাবে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে।

রাজধানীর বড়বাগ এলাকায় মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নতুন সড়কে ‘আগেভাগে বসে লাভবান বেশি হই’ মানসিকতায় সেখানে খাওয়ার দোকান থেকে শুরু করে গাড়ির গ্যারেজ, কাপড়ের দোকানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ এলাকার কয়েকজন বাড়ি মালিক জানান, নতুন এ সড়কের ভবন বা গ্যারেজ মানুষ ব্যবসায়িক কাজে বেশি ভাড়ায় নিতে আগ্রহী। ভালো ভাড়া পাওয়ায় তাদেরও এতে কোনো আপত্তি নেই। পল্লবী আবাসিক এলাকার প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত ভবন ছাড়াও ভিতরের ভবনগুলোতে এখন বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পল্লবী এমআই মডেল হাইস্কুলের পাশেই কয়েকটি বাড়ির গ্যারেজে ও নিচতলায় মুদি দোকান, বিউটি পারলার, লন্ড্রি, খাবারের দোকান ও টেইলার্স। এক বাড়ি মালিক জানান, তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিলে মাসে ১২ হাজার টাকাসহ এক মাসের অগ্রিম ভাড়ার টাকা পাওয়া যায়। অন্যদিকে একই ফ্ল্যাট কোনো অফিস বা কিন্ডারগার্টেন মালিকের কাছে ভাড়া দিলে তিন গুণের বেশি মাসিক ভাড়া পাওয়া যায়। ‘পজেশন’ হিসেবে দিলে তো আরও লাখ টাকা আদায় করা যায়।

আবাসিক এলাকার চরিত্র অনেক আগে থেকেই হারাতে শুরু করেছে ধানমন্ডি। গত কয়েক বছরে সেখানে পুরনো আবাসিক ভবন ভেঙে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, রেস্টুরেন্ট, বিউটি পারলার ও বিপণি বিতান। সাতমসজিদ সড়কটির পুরোটিই এখন ব্যস্ততম এক বাণিজ্যিক এলাকা। এ অব্যবস্থাপনার কারণে ধানমন্ডিজুড়ে দিন ও রাতে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। এতে এ এলাকার বাসিন্দারা তীব্র পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছেন। বনানী আবাসিক এলাকার ভবনগুলোও ব্যবহূত হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে। এ এলাকায় সবচেয়ে বেশি রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে ১১ নম্বর সড়কে। এ সড়কে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক দোকান। কামাল আতার্তুক এভিনিউতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। গুলশান এভিনিউ এলাকার দৃশ্যপটও গত এক দশকে আমূল বদলে গেছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকান, রেস্টুরেন্ট, মোবাইল কোম্পানির দোকান ও ব্যাংক ইত্যাদির দাপটে এলাকাটি এখন বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত। বাদ যায়নি উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় বৈধ ও অবৈধ মিলেয়ে প্রায় ২৫ হাজারের মতো কারখানা আছে। এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, অভিজাত এলাকার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু দুর্বলতার কারণেই তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এ ছাড়া এসব ভবনের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকারীদের সমস্যায় পড়তে হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ছয় মাসের মধ্যে নগরীর আবাসিক এলাকায় সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আবাসিক এলাকায় ব্যবসা প্রতিরোধে বাণিজ্যিক ট্রেড লাইন্সেস প্রদান বন্ধ করে দেয়। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা ও বারিধারা আবাসিক এলাকার অবৈধ ও বাণিজ্যিক স্থাপনার ওপর সমীক্ষা শেষে রাজউকের একটি দল এসব এলাকা পরিদর্শন করে এবং পর্যায়ক্রমে এগুলো উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়ির বেসমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করলে সেগুলোও উচ্ছেদ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তের কোনো বাস্তবায়ন নেই।

সর্বশেষ খবর