রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাহিত্যপ্রেমিদের মিলন মেলা ভাঙল

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

সাহিত্যপ্রেমিদের মিলন মেলা ভাঙল

সাহিত্যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ডিএসসি পুরস্কার প্রদান, ব্রিটিশ সাহিত্য জার্নাল ‘দ্য গ্রান্টার’-এর মোড়ক উন্মোচন, এইসঙ্গে আড্ডা আর আলোচনার মধ্যদিয়ে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত তিন দিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য আসর ‘ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’ গতকাল শেষ হয়েছে।

আড্ডা আর কথোপকথনে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে বিশ্বসাহিত্যের দিকপালেরা তিন দিন জমিয়ে রেখেছিলেন সাহিত্যপ্রেমীদের। এই আসরে সাহিত্যের জয়গান গেয়েছেন বিশ্বের ২৪টি দেশের দুই শতাধিক সাহিত্যিক। ম্যান বুকার জয়ী সাহিত্যিক থেকে শুরু করে অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পীরাও ছিলেন এ আসরে। এই উৎসবে বরেণ্য সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার আহ্বান জানান। বিভিন্ন মিলনায়তন, কক্ষ ও লনে সাহিত্য আড্ডা ও সেশনের পাশাপাশি আসরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিল বইয়ের বিকিকিনি। সকাল ৯টায় শুরু হয়ে আয়োজন চলে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত। সকালে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে উজানভাটি শিল্পীগোষ্ঠীর মারফতি গানের মধ্য দিয়ে সমাপনী দিনের আয়োজন শুরু হয়। ৩৮টি অধিবেশনসহ তিন দিনে মোট শতাধিক সেশন অনুষ্ঠিত হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এ উৎসবের আয়োজক ছিল যাত্রিক। উৎসব পরিচালক ছিলেন কাজী আনিস আহমেদ, সাদাফ সায্্ সিদ্দিকী ও আহসান আকবার। এবারের উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিল ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন, সহ-পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিল ব্র্যাক ব্যাংক।

ডিএসসি পুরস্কার : সমাপনী সন্ধ্যায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে প্রদান করা হয় দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার ডিএসসি প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচার। ‘দ্যা স্টোরি অব এ ব্রিফ ম্যারেজ’ বইয়ের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন শ্রীলংকার তরুণ সাহিত্যিক অনুক অরুদপ্রগাসম। বিচারকমণ্ডলির প্রধান ছিলেন ভারতীয় নারীবাদী লেখিকা রিতু মেনন। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক অনুকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের সমাপনী আসরের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ডিএসসি পুরস্কারের সঙ্গে ২৫ হাজার ডলারের সম্মাননাও প্রদান করা হয়। এ বছর ডিএসসি প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অনুক অরুদপ্রগাসম ছাড়া আরো ছিলেন অঞ্জলি জোসেফ, আরবিন্দ আদিগা, করণ মহাজন ও স্টিফেন অল্টার। রিতু মেননের সভাপতিত্বে এ বছর বিচারকমণ্ডলিতে ছিলেন ভ্যালেন্টাইন কুনিংহাম, স্টিভেন বারনেস্টাইন, ইয়াসমিন আলীভাই ও সিনেথ ওয়াল্টার পারেরা।

‘গ্রান্টা’র মোড়ক উন্মোচন : সমাপনী দিনে বিশ্বখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী ‘গ্রান্টা’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক করণ মহাজন, মার্কিন লেখক ক্যাথরিন ডন, গ্রান্টার সম্পাদনা সহকারী যুক্তরাজ্যের ইলিয়ন চেন্ডলার ও মার্কিন ঔপন্যাসিক জেসি বেল।

 গ্রান্টা সাময়িকীতে নিজের লেখা প্রসঙ্গে করণ মহাজন বলেন, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সংস্কৃতির মধ্যে দারুণ মিল হয়েছে। আমেরিকার জীবন যাপন, সেখানকার নাগরিকদের বেড়ে ওঠা- ইত্যাদি নানা বিষয় আমার লেখায় উঠে এসেছে। আমেরিকাতে বাস করলেও সেখানে আমি ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মার্কিন সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই লেখক বলেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা চোখে পড়ার মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের প্রসঙ্গে করণ বলেন, আমেরিকায় অভিবাসীদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, বিশ্বের অন্য কোথাও তেমনটা দেয়া হয় না। আফ্রিকার উগ্রবাদীদের কারণে অন্য দেশের অভিবাসীরা সংকটে ভুগছে। তারপরও আমেরিকায় অভিবাসীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছে।

দিনের অন্যান্য সেশন : সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ছিল ‘উইমেন, আর্ট অ্যান্ড পলিটিকস’ শীর্ষক অধিবেশন। বি রাওলাটের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন লেখক ও অভিনেতা এস্থার ফ্রয়েড, স্পোকেন ওয়ার্ড আর্টিস্ট বিগো চিওল, লেখক ও অভিনেত্রী নন্দনা সেন এবং লিট ফেস্টের পরিচালনা সাদাফ সায্। এতে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন আরো বেশি কর্মমুখী হয়ে উঠছেন। তবে ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নারীদের প্রতি এখনো অসহিঞ্চু আচরণ করা হয়ে থাকে। তাই নারীদের গল্প এখন নারীদেরই বলতে হবে। আর নারীদের প্রতি অসহিঞ্চুতার কারণ যেমন পুরুষরা, তাই এই অসহিঞ্চুতা রোধে পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ছিল ‘ভাষার রাজনীতি, ভাষার অর্থনীতি’ শিরোনামে অধিবেশন। কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হকের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ লেখক কিননর রায়, সেবন্তি ঘোষ ও কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। ভাস্কর নভেরা প্রদর্শনীলয়ে ছিল ‘পেন : কলমকে কেন এত ভয়?’ শীর্ষক অধিবেশন। সাংবাদিক তানিম আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন সমকালের ফিচার সম্পাদক কবি মাহবুব আজীজ, কথাসাহিত্যিক আহমেদ মোস্তফা কামাল, কথাসাহিত্যিক লাভলী বাশার ও ভারতীয় সাহিত্যিক বল্লারি সেন। এ অধিবেশনে বক্তারা বলেন, কলম আসলে প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত এক শ্রেণীর মানুষ ভিন্নমতের মানুষকে ভয় পায়। এর জন্যই তাদেরকে হত্যা, তাদের নির্যাতন চলছে।

দিনের অন্যান্য অধিবেশন : ‘দ্য সিজন ইন কুয়েন্সি: এ ট্রিবিউট টু জন বার্গার’ সিনেমাটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় উৎসব মঞ্চে। এতে উপস্থিত ছিলেন অস্কারজয়ী স্কটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইন্টন। কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে সকাল ১০টায় ‘ব্লোন টু বিস’ শিরোনামের অধিবেশনে যোগ দেন ক্যাথেরিন লেকে, কারান মহাজন। এরপর সকাল সোয়া ১১টায় ‘কম্যুনিজম অ্যান্ড জিওনিজম : আনএক্সপেকটেড ফিউচারস’ শিরোনামে অধিবেশনে অংশ নেন চার্লস গ্লাস, রিচার্ড লয়েড পেরি, কাজী নাবিল আহমেদ, ডমিনিক জিগলার। দুপুরে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি লুকিং ব্যাক’ শীর্ষক অধিবেশনে অংশ নেন ফেরদৌস আজিম, ফখরুল আলম উপস্থিত ছিলেন। ‘গঙ্গাস’ : এ রিভার রানস থ্রু ইট’ শিরোনামের সেশনে অংশ নেন ভিক্টর মালেট। লনে সকালে ‘পেন: মেজারড স্পিচ’ শিরোনামের অধিবেশনে অংশ নেন জন ম্যাকিনসন, অ্যান্ড্রু ফাইনস্টান, সি আর আব্রার, জাস্টিন রুলাট ও জয়তী মালহোত্রা। ‘চেজলেস চ্যাটার অব ডেমনস’ শিরোনামের অধিবেশনে বক্তৃতা করেন অশোক ফেরি। ‘সিরিয়া: ওয়ার উইদআউট অ্যান্ড’ শিরোনামের অধিবেশনে অংশ নেন চার্লস গ্লাস ও আজিম ইব্রাহীম। ‘উই নিড টু টক অ্যাবাউট শ্রিবার’ শিরোনামে অধিবেশনে অংশ নেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক লিওনেল শ্রিবার। ‘মিছিলের দিনগুলো: মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কবিতা’ শিরোনামের আয়োজনে কবিতা পাঠ করেন হেলাল হাফিজ।

ভাস্কর নভেরা প্রদর্শনীলয়ে ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ অধিবেশনে অংশ নেন ডেভিজ সেজলি ও জেসি বল, ‘নাইনটিন সেভেনটি ফোর: দ্য সাইলেন্ট ইয়ার’ শিরোনামের অধিবেশনে অংশ নেন নওমি হোসেন ও সৈয়দ বদরুল আহসান। ‘দ্য ইনভিজিবল ইউনিভার্স’ শিরোনামের সেশনে অংশ নেন বেলাল বাকি।

কসমিক টেন্টে আট থেকে চৌদ্দ বছরের শিশুদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল ‘ফান ম্যাথ ফর কিডস’। এই আয়োজনটিতে অংশ নেন নন্দনা সেন। ‘ডটারস অব জোড়াসাঁকো’ শিরোনামের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এরপর। ‘ধর্ষণ- পৌরুষের ক্ষমতা, পৌরুরষের অক্ষমতা’ অধিবেশনে অংশ নেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, রিতা দাস রায়, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, বিনা বিশ্বাস অংশ নেন। নজরুল মঞ্চে সকালবেলায় ছিল ‘পরান দ্য পোস্টম্যান’ শিরোনামের কবিতা আসর। পরে ‘স্বরচিত কবিতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা আবৃত্তি’ শিরোনামের অধিবেশনে অংশ নেন জহরসেন মজুমদার ও জুয়েল মাযহার।

 

সর্বশেষ খবর