রাজধানীর উত্তর কাফরুল এলাকার বাসিন্দা তপন মিয়া এত দিন বাড়ির ট্যাক্স দিতেন ২৫ হাজার টাকা। আর এখন তাকে ট্যাক্স দিতে হবে ৭৮ হাজার টাকা। এতে করে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার এই বাসিন্দা। একই অবস্থা দক্ষিণ সিটির আওতায় উত্তর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা আজমল আলীর। তার বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ১৮ হাজার টাকা। এখন তাকে গুনতে হচ্ছে ৬০ হাজার ৭২০ টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স। বর্ধিত ট্যাক্সই এখন রাজধানীর মূল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে চলমান হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্নির্ধারণের প্রতিবাদে ‘আমরা ধানমন্ডিবাসী’ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন ও ডিএসসিসি মেয়রের হাতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রতীকী অনশন করেছে সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণমোর্চা, বাংলাদেশ আম-জনতা ইনসাফ পার্টি ও বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক পার্টি। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা কোনো হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াচ্ছি না। ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে একটা সমতা আনছি। প্রতি পাঁচ বছর পর পর হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের একটা নিয়ম আছে, যা এত দিন করা হয়নি। বাসা ভাড়া বেড়ে বাড়ির মালিকদের আয় বেড়েছে কিন্তু ট্যাক্স বাড়েনি। এ ছাড়া একেক এলাকায় ভাড়া একেক রকম। তারা ভাড়া বেশি নিয়ে ট্যাক্স কম দিয়ে সুবিধা নিয়েছেন। আমরা সেটার সমতা আনার উদ্যোগ নিয়েছি। আর পুরো দেশের মধ্যে শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ট্যাক্সের হার ১২%। অন্য সব সিটির ট্যাক্স এর তুলনায় অনেক বেশি।’ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দুই সিটিতে ৩ লাখ ৭০ হাজার হোল্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরে দুই লাখ আর দক্ষিণে ১ লাখ ৭০ হাজার হোল্ডিং। এসব হোল্ডিং থেকে প্রতি অর্থবছরে ৩৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য এ দুই সিটিতে রয়েছে ১০টি কর অঞ্চল। এ দুই সিটির ভবনমালিকরা অভিযোগ করে বলেন, নতুন ও পুরনো বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন ভবনের হোল্ডিং ট্যাক্স সমতায় আনা বা পুনর্মূল্যায়নের নামে অস্বাভাবিক হারে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া মেগাসিটি ঢাকার বেশির ভাগ ভবনের ১০ থেকে ১৫ গুণ হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকার দুই সিটিতেই হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির ঘটনায় ভাড়াটেরা আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ সিটি করপোরেশনের বৃদ্ধি করা এই অতিরিক্ত হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের বিরূপ প্রভাব পড়বে হোল্ডিং মালিকদের পাশাপাশি ভাড়াটেদের ওপর। এমনিতেই হোল্ডিং মালিক পক্ষ প্রতিবছর বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করে। আর এর সঙ্গে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হবে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি। দুই সিটি করপোরেশনই প্রতিটি হোল্ডিংয়ের মালিকের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানাতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে উেকাচ ও বখশিশ বাণিজ্য। ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪-এর হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ নিয়ে শুরুর পর থেকে বখশিশ ও উেকাচ বাণিজ্য চলছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে ডিএসসিসির উপ-কর কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জমাদ্দারকে উেকাচের টাকাসহ হাতেনাতে আটক করে পুলিশ। এরপর ডিএসসিসি থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ব্যাপারে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এবং প্রমাণ থাকলে আমাদের হটলাইন বা লিখিতভাবে জানান। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজধানীর উত্তরায় হোল্ডিং ট্যাক্স সমতায় আনার নামে জেনারেল রি অ্যাসেসমেন্টের (বৃদ্ধি) কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে পুরো ডিএনসিসিতেই সমতায় আনার নামে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। মিরপুর দারুস সালাম এলাকার বাসিন্দা আবদুল মজিদ ভূঁইয়ার বাড়ির ট্যাক্স ছিল ১২ হাজার টাকা। এখন তার ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগের চেয়ে তাকে তিন গুণ বেশি ট্যাক্স গুনতে হবে। এ ধরনের অভিযোগ ডিএনসিসির পুরো এলাকাতেই রয়েছে। অনেক বাড়ির মালিক ট্যাক্স কমানোর জন্য সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ছুটছেন। তদবির শুরু করেছেন কর্মকর্তাদের কাছে। এ সুযোগে ডিএনসিসির কিছু এলাকায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়ার নামে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। এমন অভিযোগ ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরেও এসেছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিললে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ট্যাক্স বৃদ্ধির ব্যাপারে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াব না। তবে ২০০৮ সালের রেট অনুয়ায়ী নতুন ও পুরনো ভবনের ট্যাক্সের সমতা আনব। যদি মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওই ভবনের ট্যাক্স ২০০৩ সালের রেট অনুয়ায়ী নির্ধারিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সেই ট্যাক্স ২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে বর্তমান রেট ৪ টাকা ৫০ পয়সায় নতুনভাবে নির্ধারণ করা হবে।’ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ির মালিকদের কাছে সিটি করপোরেশন থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে চিঠি। সেখানে বর্তমান ট্যাক্সের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি লেখা থাকায় কপালে ভাঁজ পড়েছে বাড়ির মালিকদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ইউছুফ আলী সরদার বলেন, ভবন সম্প্রসারণ ও বর্ধিত করায় কিছু বাড়ির ট্যাক্স যৌক্তিকভাবে বাড়বে। তবে তারা আবেদন করলে ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ আছে বা কিস্তিতে পরিশোধেরও ব্যবস্থা আছে।