বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৮২

এক শিশুর সন্ধানে মেলে ১৭টির

মির্জা মেহেদী তমাল

এক শিশুর সন্ধানে মেলে ১৭টির

নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায় বাসার সামনে খেলছিল ৮ বছর বয়সী শিশু বায়েজিদ। অনেকক্ষণ কোনো সারা শব্দ নেই বায়েজিদের। তার মা খোঁজ করতে বাসা থেকে বেরিয়ে ‘বায়েজিদ বায়েজিদ’ বলে ডাকতে থাকেন। কিন্তু বায়েজিদের সাড়া নেই। কোথায় গেল ছেলেটা? এমন প্রশ্ন মাথায় নিয়ে খোঁজ করছেন তিনি বায়েজিদের। এদিক সেদিক, পাশের বাসা, এমাঠ থেকে ওমাঠ। কোথাও নেই। বায়েজিদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলছে তাকে দেখেনি। কেউ বলছে একটি মাইক্রোবাস বাসার সামনে দেখেছে। এমন নানা কথাবার্তা শুনে বায়েজিদের মা পাগলপ্রায়। খবর শুনে বায়েজিদের বাবা বাইরে থেকে ছুটে আসেন। এলাকার লোকজন তাদের সঙ্গে মিলে খোঁজখবর করতে থাকে। মাইকিং করা হয় প্রতিটা অলিগলিতে। কিন্তু বায়েজিদকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করতে করতে সন্ধ্যা নামে। রাত পেরিয়ে দিন আসে। বায়েজিদ; আসে না বাবা মায়ের কাছে। বায়েজিদের বাবা মা কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। ঘটনাটি গত বছর ডিসেম্বরের। বায়েজিদ নিখোঁজের পর মানুষের ঢল নামে তাদের বাসায়। থানা পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ নিজের মতো করে কাজ করতে থাকে। ঘটনার পরদিন ২৮ ডিসেম্বর বায়েজিদের বাবার ফোনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কল আসে। ‘পাঁচ লাখ টাকা না পাইলে বায়েজিদকে হত্যা করুম। ছেলেকে যদি পাইতে চাস, টাকা নিয়া দেখা করিস। চালাকি করবি, ধরা খাইবি। পোলার লাশ ভাসব মেঘনায়।’

ফোনে এমন হুঙ্কারে বায়েজিদের বাবা দিশাহারা। কোথায় টাকা পাবে, কে দেবে তাকে টাকা। এমন সব চিন্তা ভাবনায় তিনি অসুস্থ হতে থাকেন। তার মনে পড়ে যায়, কদিন আগে মেঘনায় পাওয়া গেছে দুটি শিশুর লাশ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার প্রিয় সন্তানের মুখ। নাহ, যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করতে হবে। যেখান থেকে হোক তাদের টাকা দিয়ে ছেলেকে ফেরত আনতে হবে। দিন যায়, সপ্তাহ যায়-বায়েজিদের খবর নেই। বাবা মা ছেলেকে না পেয়ে কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। ৮ জানুয়ারি বায়েজিদের বাবা মো. ডালিম বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। নম্বর-৩৭১। বায়েজিদের মা সেই জিডি নিয়ে দেখা করেন র‌্যাব কর্মকর্তার সঙ্গে। র‌্যাব ১১ বায়েজিদকে উদ্ধারে নতুন করে কাজ শুরু করে। বায়েজিদের মা র‌্যাব অফিসে গিয়ে বলেন, ‘সকালে বাসার সামনে থেকে নিয়ে গেছে বায়েজিদরে। মোবাইল ফোনে ৫ লাখ টাকা চাইছে। বিকাশ করতেও টাকা চাইছিল। আমি দেড় হাজার টাকা বিকাশ করছি।’ এই কথা শুনে র‌্যাব ১১-এর কর্মকর্তা ভাবতে শুরু করেন। তিনি মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। নানা কৌশলে সেই র‌্যাব কর্মকর্তা পেয়ে যান মোবাইলে হুমকি দেওয়া সেই ব্যক্তিকে। তার নাম টিটো। দেড় হাজার টাকা সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাঁসারি এলাকা থেকে তোলেন এই টিটো। র‌্যাব ফাঁদ পেতে টিটুকে কমলাপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। র‌্যাব  গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে ১৮ জানুয়ারি চিটাগং রোড এলাকা থেকে বায়েজিদকে উদ্ধার করে। ২১ দিন পর বায়েজিদ ফিরে তার বাবা মায়ের কাছে। টিটোকে র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে জেরা করা হয়। জেরার মুখে টিটো ফাঁস করে ভয়ঙ্কর এক গ্রুপের তথ্য। র‌্যাব কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে অজানা সব তথ্য শুনে হতবাক! র‌্যাব কর্মকর্তারা ভাবছেন, এও কি সম্ভব মানুষের পক্ষ্যে! টিটো ফাঁস করে ১৭ শিশু অপহরণের কাহিনী। এক শিশু সন্ধান করতে গিয়ে ১৭ শিশুর অপহরণের খবর মিলে যায় অপহরণকারীর কাছে। অপহরণের পর তারা কোনো শিশুকে হত্যা, কোনো শিশুকে মুক্তি বা কোনো শিশুকে বিদেশে পাচার করা হয়, তার সবই ফাঁস করে। র‌্যাব জানতে পারে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাঁসারি এলাকায় অবস্থিত চক্রের আস্তানার। র‌্যাব মাঠে নামে পুরো চক্রকে পাকড়াও করতে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে পাচারকারীদের গ্রেফতার করে। এরা হলো জাকির হোসেন (৫৫), জাকিরের স্ত্রী মর্জিনা বেগম ওরফে বানেছা (৪০), টিটু (২৯), মোহাম্মদ হোসেন সাগর ওরফে বেলু ওরফে  দেলু (২২), জেসমিন বেগম (৩৭) ও আসলাম ওরফে আলামিন (২৮)। তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, তিন রাউন্ড গুলি, দুটি চাকু, একটি চাপাতি, এক হাজার ২০ পিস ইয়াবা, অপহূত শিশুদের অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহূত ২৩টি চেতনানাশক ইনজেকশন, দুটি ব্যবহূত ইনজেকশন, ১৪টি সিরিঞ্জ এবং ১৭টি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। তারা স্বীকার করেছে দুই বছরে তারা অপহরণ করে ১৭ শিশুকে। এদের মধ্যে আটজনকে মুক্তিপণের বিনিময়ে  ছেড়ে দিয়েছে। ছয় শিশুকে পাচার করেছে বিদেশে। হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে দুই শিশুর।

ভয়ঙ্কর সেই আস্তানা : টিনের ছাউনির একতলা বাড়ি। পেছনের অংশে ডোবা। সামনে খোলা মাঠ। এমনই এক নির্জন বাড়িতে চক্রের আস্তানা। বাড়িটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নিমাইকাঁসারি এলাকায় অবস্থিত। দুই শিশুসহ চারজনকে খুন করা হয়েছে এখানেই। জাকির-বানেছার টিনশেডের একতলা এই বাড়িটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাসায় ঢোকার প্রধান গেট বন্ধ। সামনের  দেয়ালে জমির মালিকানা-সংক্রান্ত সাইনবোর্ড। তাতে  লেখা, জমির মালিক বানেছা। স্বামীর নাম জাকির  হোসেন। জাকির-বানেছা দম্পতি প্রায় ১২ বছর ধরে এই বাসায় ভাড়া ছিলেন। বছর দেড়েক আগে ইউনুছ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বাড়িটি কিনেছেন। স্থানীয়রা জানায়, বাসায় ঢোকার প্রধান গেট অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। জাকির-বানেছা এলাকায় বাবা (ইয়াবা) ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এখানেই সব শিশুকে এনে জড়ো করে রাখা হতো। চেতনা নাশক ইনজেকশন দিয়ে ফেলে রাখা হতো শিশুদের।

জাকির-বানেছার বাসায় যেভাবে চার খুন : জাকির-বানেছার নিমাইকাঁসারির বাসায় চারজন খুনের কথা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে স্বীকার করেছেন চক্রের সদস্য টিটু। জবানবন্দিতে টিটু বলেছেন, জাকির হোসেনের সিদ্ধিরগঞ্জের বাড়িতে খুন করা হয়েছে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এই খুন করা হয়। চক্রের সদস্য টিটু স্বীকার করেছেন, তিনি নিজে চার খুনেই জড়িত ছিলেন। অপহরণ করে দুই শিশুকে জাকির  হোসেনের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর শিশু দুটিকে খুন করে লাশ কাঁচপুর ব্রিজ থেকে ফেলে দেন টিটু, দেলু ও জাকির। নাজমুল নামের শিশুটিকে রূপগঞ্জের ভুলতা  থেকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়। আর আকাশকে সিদ্ধিরগঞ্জের বাগমারা থেকে আনা হয়। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একই দিন এ দুই শিশুকে খুন করে অপহরণকারী চক্র। খুনের পর  সেদিন রাত ১১টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের জাকিরের বাসা  থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয় দুজনের লাশ। গাড়ি চালিয়েছিলেন দেলু। গাড়িতে জাকিরও ছিলেন।

ফোন করে পরিবারগুলোর কাছে টাকা চান টিটু : ইমন শিকদার (১৩)। তার বাবার নাম বাবুল শিকদার। বাড়ি বরিশাল। সে বরিশালের বিমানবন্দর এলাকার একটি মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। গত বছর ২০ নভেম্বর বরিশাল থেকে ঢাকায় আসার জন্য লঞ্চে ওঠে। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। শিশু ইমনের পারিবারিক সূত্র জানায়, টিটু নামের একজন ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছেন, কিন্তু টাকা দিতে পারেননি। একই কথা জানালেন রাজধানীর মানিকনগরের বাসিন্দা সানির পরিবার। ২২ ডিসেম্বর তার ছয় বছরের ছেলে সানি অপহূত হয়। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ চেয়েছেন। এ দুটি শিশুর মতো আরও কয়েকটি শিশুকে অপহরণ করে বিদেশে পাচার করার কথা স্বীকার করেছেন টিটু ও অন্যরা। গ্রেফতার হওয়া জেসমিন ৭০-৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে চক্রের সদস্য শাহাবুদ্দিন ও মনিরের কাছে সাতটি শিশু বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন। শাহাবুদ্দিনকে গ্রেফতার করলে অনেক শিশুর সন্ধান মিলবে।

অপহরণের পর মুক্তিপণ : রাজধানীর মধ্য বাড্ডা থেকে রাকিব হোসেন ইমরানকে (৮) অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ নিয়ে ৪ জানুয়ারি ছেড়ে দেয়। জুবায়ের ইসলাম (১৪) নামের এক কিশোরকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অপহরণ করা হয়। পরে মুক্তিপণ নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়।

 

 নাজমুল (১০) নামের শিশুটিকে সাভার থেকে অপহরণ করার পর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে  দেয় এই অপহরণকারী চক্র। মুক্তিপণ দিয়ে আরও সাতটি শিশু মুক্তি পেয়েছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর