বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৮৩

হ্যান্ডস আপ বলেই ব্রাশফায়ার

মির্জা মেহেদী তমাল

হ্যান্ডস আপ বলেই ব্রাশফায়ার

প্রতিদিনের মতো সেই রাতেও মুহসীন হল ও সূর্যসেন হলে ঘুম নেমেছিল। ঘুম নেমেছিল সূর্যসেন হলের ৬৩৫ ও ৬৪৮ নম্বর কক্ষেও। পার্থক্য শুধু এটুকুই, এই দুই কক্ষের ঘুমন্ত সাতজন তরুণ মধ্যরাতে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পরিণত হয়েছিল এক শিহরণ জাগানো খবরে। ১০-১৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি ওই দুই কক্ষ থেকে সাতজন ছাত্রকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করে মুহসীন হলে নিয়ে যায়। স্টেনগানের হিংস  গর্জনে প্রকম্পিত হয় রাতের আঁধার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনের করিডরে একসঙ্গে সাত ছাত্রের দেহ ঝাঁজরা হয় বুলেটের সুতীক্ষ আঘাতে। একটার ওপর আরেকটা লাশ পড়ে থাকে। ৪৩ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ আলোচিত ‘সেভেন মার্ডার’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞের সংবাদ মুখে মুখে রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাজধানী ছাপিয়ে গোটা দেশ। আতঙ্ক তখন চারদিকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল। সাধারণ ছাত্ররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হল ছাড়তে শুরু করে। রাতের বেলা ভৌতিক পরিবেশ। ১৯৭৪ সালের ৬ এপ্রিলের পত্রিকায় কালো হেডিংয়ে প্রধান শিরোনাম হয়। নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিদেশি গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে এ সংবাদটি প্রকাশ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এই সেভেন মার্ডারের ঘটনার মতো আর কোনো ঘটনাই সেই সময়ে এমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনের ঘটনা বলতে প্রথমেই চলে আসে ঢাবির এই ‘সেভেন মার্ডার’ এর ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডে যাদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের সেই দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। উপরন্তু তারা দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। যে কারণে এ ঘটনার বিষয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। যদিও প্রধান আসামি যিনি ছিলেন, তিনি সম্প্রতি মারা যান। কিন্তু কেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারে কারা কেন এই বীভৎস খুনে জরিত। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে এই হত্যাযজ্ঞে শফিউল আলম প্রধান সরাসরি জড়িত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই নারকীয় ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের তদন্তে বলা হয়। বিচার কাজ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলেই বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ’৭৫-এর পর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। বরং জিয়া সরকার আমলে তাকে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেওয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এই সেভেন মার্ডারের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত, সেসময়ের সাংবাদিক যারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন—এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে সে রাতের নানা কাহিনী।

সেদিন যা ঘটেছিল : ৪ এপ্রিল, ১৯৭৪ সাল। রাতে সূর্যসেন হলের ৬৩৫ নম্বর কক্ষে কয়েকজন ছাত্র গল্প করছিলেন। ওই কক্ষেই ছিলেন নাজমুল হক কোহিনুর। রাত ১২টার কিছু পরে কোহিনুরের বন্ধুরা যে যার রুমে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পরই সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ১টা ২৫ মিনিটে সূর্যসেন হল থেকে প্রথম ২-৩টা গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় ১০ থেকে ১৫ জন অস্ত্রধারী হলের ভিতর ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চম তলায় উঠে আসে। প্রথমে তারা ৬৩৪ নম্বর রুমের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে কোহিনুর নাম ধরে ডাকতে থাকে। ওই কক্ষের ভিতর থেকে এক ছাত্র পাশের কক্ষে যোগাযোগ করতে বলেন। অস্ত্রধারীরা পাশের ৬৩৫ নম্বর কক্ষের দরজার সামনে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। কোহিনুরকে দরজা খুলতে বলে। কিছুক্ষণ এ অবস্থা চলতে থাকলে কোহিনুর ভিতর থেকে দরজা খুলে দেন। এরপরই অস্ত্রধারীরা তাদের ‘হ্যান্ডস আপ’ করতে বলে। কোহিনুরসহ ওই কক্ষে তখন ছিলেন চারজন। চারজনই মাথার ওপর হাত তুলে কক্ষ থেকে বের হন। অস্ত্রধারীদের অপর গ্রুপ ৬৪৮ নম্বর কক্ষ থেকে আরও তিনজনকে একই কায়দায় বের করে নিয়ে আসে। এই সাতজনের দিকে অস্ত্র তাক করে সারিবদ্ধভাবে হাঁটিয়ে ৫ তলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। এ সময় কোহিনুর বিষয়টি অঁচা করতে পারে। তাকে প্রাণে না মারার জন্য আকুতি-মিনতি করতে থাকেন। দোতলা পর্যন্ত তারা নামার পর ২১৫ নম্বর কক্ষের সামনে গিয়ে আরও এক ছাত্রের খোঁজ করে অস্ত্রধারীরা। ওই ছাত্র বিপদ আঁচ করতে পেরে জানালা ভেঙে দোতলা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েন। ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যায়। ওই ছাত্রকে না পেয়ে অস্ত্রধারীরা জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পায় যে, কেউ দৌড়ে পালাচ্ছেন। তখন জানালা দিয়ে অস্ত্রধারীরা গুলি করে। কিন্তু ওই ছাত্রটি পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। সাতজন হতভাগ্য ছাত্রকে যখন সূর্যসেন হল থেকে মুহসীন হলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় তখন রাত ২টা চার মিনিট। মুহসীন হলের টিভিরুমের সামনের করিডরকে বধ্যভূমি হিসেবে নির্বাচিত করে সাতজনকে সেখানে দাঁড় করানো হয়। রাত ২টা ১১ মিনিটে হতভাগ্য ওই ছাত্রদের লক্ষ্য করে ‘ব্রাশফায়ার’ শুরু হয়। গুলিবিদ্ধ ওই ছাত্ররা লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারান। রক্তে ভেসে যায় পুরো করিডর। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও অস্ত্রধারীরা এ সময় ফাঁকা গুলি ছুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরপর রাত ২টা ২৫ মিনিটে তারা ধীরে ধীরে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ভোর ৪টা ৫৫ মিনিটে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এর অল্প সময়ের মধ্যে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে সামান্য দূরে রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। অন্যদিকে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। অস্ত্রধারীরা রাত ১টা ২৫ মিনিট থেকে তাদের তৎপরতা শুরু করে। হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ২টা ২৫ মিনিটে চলে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অস্ত্রধারীদের এমন তৎপরতায়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে যায়নি। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। নিহতদের পরিচয় : নাজমুল হক কোহিনুর, সোশিওলোজি এমএ ২য় পর্ব, গ্রাম বৈলা, রূপগঞ্জ। মো. ইদ্রিস, এমকম ১ম পর্ব, ১১৫/১১৬ চক মোগলটুলী, ঢাকা। রেজওয়ানুর রব, প্রথম বর্ষ (সম্মান), সোশিওলোজি, ৩৯/২, পাঁচ ভাই ঘাট লেন, ঢাকা।  সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ, প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, ৩৪ ঠাকুর দাস লেন, বানিয়ানগর, ঢাকা। বশিরউদ্দিন আহমদ (জিন্নাহ), এমকম ১ম পর্ব, ২৯ ডিস্ট্রিলারি রোড, ঢাকা। আবুল হোসেন প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এবাদ খান, প্রথম বর্ষ (সম্মান) সোশিওলোজি, পাইকপাড়া, ধামরাই। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের তিন দিন পর পুলিশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। অপর দুজন হলেন, কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল এবং মাহমুদুর রহমান ওরফে বাচ্চু।

সর্বশেষ খবর