সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাহাড় ধসের যত কারণ

আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস আজ

মোস্তফা কাজল

ঝুঁকিতে দেশের পার্বত্য অঞ্চল। নানা কারণে দেশের ৫০ ভাগ পাহাড় আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ আলোচনা সভার। পার্বত্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পৃথিবীর স্থলভাগের পরিমাণ শতকরা ২৭ ভাগ। আর ২২ ভাগ জায়গা জুড়ে আছে পর্বতমালা। পর্বতমালার কারণে সরাসরি উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগ। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ঝুঁকিতে পার্বত্য অঞ্চল— জলবায়ু, ক্ষুধা ও অভিবাসন। পাহাড় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন এবং বন-জঙ্গল ও গাছ উজাড়ের কারণেই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়  ধসের ঘটনা ঘটছে। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ের গায়ে জন্মানো বন-জঙ্গল এবং গাছপালা এর অভ্যন্তরীণ বন্ধন শক্ত রাখে। কিন্তু লোভী মানুষরা অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটছে। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষ বসতির প্রয়োজনেও পাহাড় কাটছে। এতেই পাহাড় ধ্বংসের পথ তৈরি হয়। এ ছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে চলতি বছরে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গার কারণে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার বেশ কয়েকটি পাহাড় ইতিমধ্যে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। এ ছাড়াও চার জেলার পাহাড়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তুলেছে। প্রায় প্রতি বছরই ছোটখাটো দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। চলতি বছর চারজন সেনাসদস্যসহ ৭৮ জন নিহত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব কিশোর বিক্রম ত্রিপুরা জানান, সরকার পার্বত্যবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া পাহাড় রক্ষায় কাজ করছে সরকার। এ ছাড়া পার্বত্য জেলার উন্নয়নে সরকার ২৪৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বরাদ্দ করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খান তৌহিদ ওসমান বলেন, পাহাড়ি বাঙালি সবাই পাহাড় কাটছে। পাহাড়ের পাদদেশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ি বনজ সম্পদ নির্বিচারে ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে তা মোকাবিলা করা যাবে না। পাহাড় রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। পাহাড়গুলো ঢালু ও খাড়া হওয়ায় ধসের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, পাহাড় ধসের প্রধান কারণ দুটি— ভূতাত্ত্বিক ও মানবসৃষ্ট। কোন অঞ্চলে তিনটি ভূতাত্ত্বিক কারণে পাহাড় ধস হতে পারে। সেগুলো হলো— পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক গঠন, বালুর বিন্যাস এবং পাহাড়ের ঢালুতা। আর মনুষ্যসৃষ্ট কারণের মধ্যে রয়েছে— পাহাড়ে চাষাবাদ এবং বন উজাড়। এসব কারণ যখন তৈরি হয় তখন বৃষ্টিপাতে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে ভিতরে পানি প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ভারী হয়ে যায়। ফলে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা ঘটে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে তিনি পাহাড় কাটা বন্ধের পরামর্শ দেন। এ ছাড়া পাহাড়ে পর্যাপ্ত গাছপালা লাগানো, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং পাহাড় থেকে বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। এক্ষেত্রে গরিব মানুষকে অন্যত্র পুনর্বাসন করার পরামর্শ দেন। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামেই পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। ওই ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি করা হয়। যার সচিব ছিলেন পরিবেশ অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক মো. জাফর আলম। কমিটি পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিল। রক্ষা ও ধস ঠেকাতে প্রণয়ন করেছিল ৩৬ দফা সুপারিশ। কিন্তু সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও। সূত্র বলছে, বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার, রাঙামাটির ১০টি উপজেলায় প্রায় ৮০ হাজার এবং খাগড়াছড়ির ৯টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের বসতি রয়েছে উঁচু-নিচু পাহাড় ও পাহাড় ঘেঁষে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশেই। এসব পরিবার যুগ যুগ ধরে বসবাস করলেও বর্ষায় কেবল মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া ছাড়া বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি প্রশাসন।

চিহ্নিত ২৮ কারণ : ২০০৭ সালের কমিটির চিহ্নিত ২৮ কারণের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ভারি বর্ষণ, পাহাড়ে বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা ইত্যাদি।

সুপারিশমালা : পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প গড়ে না তোলা। পাহাড়ে বনায়ন করা। ঢালু পাহাড়ে গাইডওয়াল নির্মাণ। নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ। যত্রতত্র বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা। ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা। চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা। পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।

পাহাড় কাটে কারা : স্থানীয় সাধারণ মানুষ ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদফতর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এমনকি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধেই পাহাড় কাটার অভিযোগ আছে। আবার প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখলেও তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে রয়েছে পুলিশের অবহেলা ও গাফিলতি। পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের আহ্বায়ক শরীফ চৌহান বলেন, পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রশাসনের টনক নড়ে। চিহ্নিত করা হয় ধ্বংসের কারণ। ১১ ডিসেম্বরকে পাহাড় রক্ষা দিবস ঘোষণা করার দাবি করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর