সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পুড়ছে কাঠ উজাড় হচ্ছে বন

টেকনাফ দিয়ে ঢুকলো আরও এক হাজার

রেজা মুজাম্মেল, কক্সবাজার (বালুখালী) থেকে

পুড়ছে কাঠ উজাড় হচ্ছে বন

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। সারি সারি তাঁবু, তার মাঝে আঁকাবাঁকা পথ। ক্যাম্পের পশ্চিম পাশেই বন ও পাহাড়ি এলাকা। গতকাল দুপুরে দেখা গেল, পাহাড়ি এলাকার দিক থেকে চার-       পাঁচজনের একদল কিশোর কাঁধে কাঠ নিয়ে ফিরছে। সব কাঠই পাহাড়ি। প্রতিজনের কাঁধে ভর করেছে ১৫ থেকে ২০ কেজি করে কাঠ।

কথা হয় কাঠ নিয়ে আসা কিশোর রাকিবের সঙ্গে। তখন সে নিজেই তার ভাষায় যা বলল তার অর্থ হলো, ‘বন থেকে এসব কাঠ কেটে আনছি আমরা। কারণ ত্রাণ হিসেবে আমাদের বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু কাঠ দেওয়া হয় না। তাই আমরা বন থেকে কাঠ কেটে তা দিয়ে রান্না করি।’ কেউ বাধা দেন কিনা জানতে চাইলে— সে বলে, ‘মাঝে মাঝে বাধা দেয়। কিন্তু আমরা কী করব? কী দিয়ে রান্না করব?’ এরই মধ্যে গতকাল টেকনাফ দিয়ে আরও এক হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যা। বাড়ছে জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের হার। এতেকরে উজাড় হচ্ছে দেশের সবুজ বন। নিধন হচ্ছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বনায়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সামাজিক বনায়নের অংশীদাররা। ধ্বংস হচ্ছে, ন্যাড়া হচ্ছে প্রকৃতির ‘খুঁটি’ খ্যাত পাহাড়। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বনায়ন মিলে এরই মধ্যে চারশ কোটি টাকার কাঠ পুড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শরণার্থীরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষ নিধন করে চলেছে। ফলে দেশীয় প্রজাতির গাছ গর্জন, হারগেজা, ঢাকিজাম, বৈলাম, দেশি জাম, তেলসুর, জারুল, বহেরা, ধারমারা, মুস, আতারগুলা, বান্দরহোলা, বাটনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিমাত্রায় কাঠ নিধনের কারণে স্থানীয় জনসাধারণ এবং বন্যপ্রাণী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক বছরের মধ্যেই এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। শঙ্কা থাকবে ভূমি ধসের। কক্সবাজার বনবিভাগ (দক্ষিণ) জোন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থী রোহিঙ্গারা চার হাজার ১৪০ দশমিক ৬০ একর ভূমি দখল করেছে। প্রতিনিয়ত এসব শরণার্থী আশপাশের পাহাড় ও সামাজিক বনায়ন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার একর সামাজিক বনায়ন এবং ২ হাজার ১৫০ একর প্রাকৃতিক বন, দক্ষিণ জোনের অধীনে দেড় হাজার অংশীদার সামাজিক বনায়ন। এরই মধ্যে সামাজিক বনায়নেরই ২০০ কোটি টাকার কাঠ নিধন করা হয়েছে। উন্নয়ন কর্মী শেখ ফরিদ বলেন, প্রতিদিন দুপুর হতেই রোহিঙ্গারা সারি সারি দল বেঁধে পাহাড় ও বন থেকে কাঠ কেটে আনে। এর মধ্যে কেউ তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে, কেউ প্রতিকেজি ৫০ টাকা দরে বিক্রিও করছে। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উপবন সংরক্ষক মো. আলী আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জায়গা দখল করে রয়েছে শরণার্থীরা। এখানে দেড় লাখ পরিবারই সামাজিক ও প্রাকৃতিক বনায়নের কাঠ পোড়াচ্ছে। প্রতি পরিবার পাঁচ কেজি করে হলেও দৈনিক সাড়ে সাত লাখ কেজি কাঠ পুড়ছে। বনের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা। এককভাবে সামাজিক বনায়নেরই পুড়েছে ২০০ কোটি টাকার কাঠ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের পরিচালক প্রফেসর ড. দানেশ মিয়া বলেন, বন উজাড়ের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্থানীয় জনসাধারণ এবং বন্য প্রাণীর ওপর। বলা যায়, এরই মধ্যে প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে। কারণ এশিয়ার অন্যতম ‘এলিফ্যান্ট করিডর’ এ এলাকায়। কিন্তু বন এখন প্রায় বৃক্ষ শূন্য। ফলে সেখানে হাতির খাবার না থাকায় তারা লোকারণ্যে চলে আসছে। একই সঙ্গে বৃক্ষ নিধনের কারণে পাহাড়গুলো এখন ন্যাড়া। ‘টপ সয়েল’ এ সরাসরি বৃষ্টি পড়লে তাত্ক্ষণিক ভূমিধস হবে। তখন কী হবে তা এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে। চবির এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘প্রকৃতিকে বিরক্ত করো না, করলে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নেবে’ এই কথাটির বাস্তবায়ন আগামী বর্ষায় দেখা যাবে। ন্যাড়া পাহাড়ে বৃষ্টি পড়লে হবে ভূমিধস। টেকনাফ বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গবেষণারত চবির বনবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ২০০৪ সালে টেকনাফ বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের ভিতরে ‘ফরেস্ট কাভারেজ’ ছিল ৩০ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছে ১৫ শতাংশ। এখন শরণার্থীদের কারণে আরও কমছে। রোহিঙ্গারা লাকড়ির জন্য ছোট ছোট চারাগুলো কেটে নিচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে চারা উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে প্রাকৃতিক বন দেশীয় প্রজাতির গাছ-শূন্য হয়ে পড়বে। এ কারণে আগামীতে এসব গাছ নিয়ে গবেষণা করার আর সুযোগ থাকবে না। একই সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে বৃক্ষ উৎপাদন না হলে দেশ থেকে এসব বৃক্ষ বিলীন হয়ে যাবে। এটি আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় প্রায় দেড়হাজার অংশীদারি সামাজিক বনায়ন করেছেন। নিয়ম মতে, বনায়নের বৃক্ষ বড় হলে তা বিক্রি করে ৪৫ শতাংশ অংশীদারি এবং ৪৫ শতাংশ পাবে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ দিয়ে বনায়ন করা হয়। বনায়ন পরিচর্যা ও পাহারা দেন অংশীদাররা। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব সামাজিক বনায়ন রোহিঙ্গাদের দখলে। এসব বন বেদখলে চলে যাওয়ায় তারা বনবিভাগের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছেন। উখিয়ার টিভি কেন্দ্র সংলগ্ন সামাজিক বনায়নের অংশীদার হুমায়ন কবির চৌধুরী বলেন, দুই অংশে আমি ২০ হেক্টর ভূমিতে সামাজিক বনায়ন করি। কিন্তু এখন সবটুকু রোহিঙ্গাদের দখলে। তবে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আমরা বন বিভাগে আবেদন করেছি। তিনি আরও বলেন, ‘ত্রাণ হিসেবে খাবার দেওয়া হলেও কাঠ দেওয়া হচ্ছে না। তাই তারা রান্নার জন্য কাঠ কাটছে। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণের তালিকায় জ্বালানি রাখলে বন উজাড় হতো না। সামাজিক ও প্রাকৃতি বন এখন অস্তিত্ব সংকটে।

টেকনাফ দিয়ে ঢুকল  আরও এক হাজার রোহিঙ্গা : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিনই তারা আসছেই। গতকালও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন (আরআরআরসি) এ তথ্য জানিয়েছে। জানা গেছে, প্রতিদিনই নতুন করে আসছে রোহিঙ্গারা। গত শনিবার এক দিনে আসে ৬২ পরিবারের ১৯২ জন শিশু, নারী ও পুরুষ রোহিঙ্গা। গত শুক্রবার আসে ৩০০ জন, বৃহস্পতিবার আসে ৩৫০ জন। এভাবে প্রতিদিনই নতুন করে গড়ে যুক্ত হচ্ছে ২০০ থেকে ৩৫০ জন করে।  উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান বলেন, ‘দুই দেশের চুক্তির পরও থেমে থেমে রোহিঙ্গারা আসছে। বাংলাদেশে যারা আসছে তারা তাদের স্বজনদের ডেকে ডেকে নিয়ে আসছে। তারা মনে করছে, রোহিঙ্গারা এখানেই ভালো আছে। তাই আসা হয়তো অব্যাহত আছে।’ আরআরআরসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়িসহ তিন উপজেলায় মোট সাতটি জোনে ভাগ করে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩ শত ২০ জন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর