মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ভোটে দুই সিটির দুই চিত্র

লাঙ্গল নৌকার অস্তিত্বের লড়াই নানা কৌশলে মাঠে তিন দল

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর থেকে

লাঙ্গল নৌকার অস্তিত্বের লড়াই নানা কৌশলে মাঠে তিন দল

রংপুর সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনকে ‘অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই’ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে সব নির্বাচনী কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেও পড়েছেন বড় তিন দলের নেতা-কর্মীরা। ভোটারদের দৃষ্টিতে এখন পর্যন্ত মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে লাঙ্গল ও নৌকা। তবে পিছিয়ে নেই ধানের শীষও। রংপুর সিটি করপোরেশন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্বাচনী এলাকার একটি অংশ। সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নিয়ে রংপুর-৩ সংসদীয় আসন। এ এলাকা লাঙ্গলের ঘাঁটি বলে পরিচিতি রয়েছে। তবে সেই চিত্র এখন পাল্টে গেছে। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ লাঙ্গলের পক্ষে থাকলেও সচেতন নাগরিকদের ভোটের হিসাব-নিকাশ উল্টো। সচেতন মানুষ চাইছে এলাকার উন্নয়ন। আর সাধারণ মানুষের আবেগে রয়েছে ‘এরশাদপ্রীতি’। এসব কারণেই সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন লাঙ্গল। রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মেয়র পদে কাউকে সমর্থন না দিলেও মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা তৃণমূল জাতীয় পার্টির ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৮ হাজারের বেশি ভোটে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুর কাছে পরাজিত হন। সে সময় ঝন্টু আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। রংপুরকে নিজেদের দুর্গ দাবি করলেও বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় জাতীয় পার্টি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। জেলার আট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টি একজন প্রার্থীও জেতাতে পারেনি। খোদ পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ তার নির্বাচনী এলাকা রংপুর সদর উপজেলায় দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এর পরও দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত হয়নি। সদরসহ পাঁচ উপজেলায় নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হন। অন্যদিকে জেলার তিনটি পৌরসভার দুটিতে কোনো প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি লাঙ্গলের দল। বদরগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে লাঙ্গলের মেয়র প্রার্থী ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৭১টি। আবার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনের মধ্যে চারটিই আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। এর পরও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনে মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

লাঙ্গলের ঘাঁটিতে নিজেদের অস্তিত্ব পোক্ত করতে চাইছেন এরশাদ। বাদ সাধেন এরশাদের ভাতিজা দলের যুগ্ম-মহাসচিব হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। তিনি হাতী প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় গত শুক্রবার আসিফকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারাদেশ আমলে না নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আসিফ। তবে আসিফকে বিজয়ের ব্যাপারে ফ্যাক্টর মনে করছেন না জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা। তিনি বলেন, রংপুরে জাতীয় পার্টির কোনো বিকল্প নেই। পার্টির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করছেন। তবে আসিফের দাবি, লাঙ্গলের স্থান দখল করেছে হাতী। ভোটের ফলাফলে লাঙ্গলের ভরাডুবি হবে। এদিকে মেয়র পদটি নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের নেতা-কর্মীরা এখন ভোটারদের মন জয় করতে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন। উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনের মতো সিটিতেও নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে চায় দলটি। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোতাহার হোসেন মণ্ডল মওলা বলেন, গত পাঁচ বছরে রংপুরে যে উন্নয়ন হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে যে ‘এরশাদ আবেগ’ ছিল তা হ্রাস পাওয়ায় মাঠ অনেকটাই নৌকার পক্ষে চলে এসেছে। নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হবে। গত নির্বাচনে মহানগর বিএনপির সহসভাপতি কাওসার জামান বাবলা মেয়র পদে লড়লেও দলের নেতা-কর্মীরা তার পাশে তেমন ছিলেন না। ভোটের ফলাফলে তার অবস্থান ছিল চার নম্বরে। তবে এবারের নির্বাচনে বাবলা দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বিএনপিও নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছে। ফলে দলটির নেতা-কর্মীরা তার পক্ষে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। বাবলা অভিযোগ করেন, ‘আমার নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ঘরোয়া বৈঠকও করতে দিচ্ছে না প্রশাসন। নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে। যে কারণে আমি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ধানের শীষের জয় হবে।’

আচরণবিধির তোয়াক্কা করছেন না প্রার্থীরা: নির্বাচনে আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কাই করছেন না মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী মেয়র প্রার্থীরা নগরের ছয়টি এলাকায় ছয়টি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করতে পারবেন। কিন্তু বড় তিন দলের মেয়র প্রার্থীরা এ বিধানের তোয়াক্কা না করে প্রতিটি ওয়ার্ডেই একাধিক ক্যাম্প স্থাপন করেছেন। একজন কাউন্সিলর প্রার্থী তার ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করতে পারবেন। সেখানে একাধিক ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। গতকাল ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে পাঁচটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ২৪ ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর ক্যাম্প রয়েছে চারটি করে আটটি। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী সুলতান আহমেদের নির্বাচনী ক্যাম্প রয়েছে আটটি। জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির বলেন, ‘আমরা ৩৩টি ওয়ার্ডে ৩৩টি নির্বাচনী ক্যাম্প করেছি। তবে একেকটি ওয়ার্ডে একাধিক ক্যাম্পের বিষয়টি আমার জানা নেই। স্থানীয় কর্মী-সমর্থকরা হয়তো করে থাকতে পারেন।’ আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু দাবি করেন, ছয়টি নির্বাচনী ক্যাম্পের বাইরে কোনো ক্যাম্প করা হয়নি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে গতকাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে চারটি, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুটি এবং ছয় কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটি করে অভিযোগে অর্থদণ্ড করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

জনতার মুখোমুখি অনুষ্ঠানে পাঁচ মেয়র প্রার্থী : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি গতকাল সকালে রংপুর টাউন হলে ‘জনতার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সাত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। উপস্থিত মেয়র প্রার্থীরা হলেন— জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, বিএনপির কাওসার জামান বাবলা, বাসদের আবদুল কুদ্দুস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এ টি এম গোলাম মোস্তাফা বাবু ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সেলিম আখতার। মহানগর সুজনের সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সুজনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য দেন জেলা সুজনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন।

সর্বশেষ খবর