সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নজর নেই নৌপথে

পলি আর ডুবোচরে ঠেকে যাচ্ছে নৌযান

রাহাত খান, বরিশাল

নজর নেই নৌপথে

নৌপথ নিয়ে নজর নেই কারও। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচল করা যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজগুলো প্রতিনিয়ত আটকে যাচ্ছে প্রমত্তা মেঘনার ডুবোচরে। নৌযান মাস্টার ও মালিকরা আগেভাগে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করলেও গুরুত্ব দেয়নি তখন। এখন তড়িঘড়ি করে মেঘনার মিয়ারচর চ্যানেলে ড্রেজিং শুরু হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নৌযান মাস্টারদের। তাদের অভিযোগ, মিয়ারচর চ্যানেলে ড্রেজিং হচ্ছে লোক দেখানো। গভীর করা হচ্ছে না প্রয়োজন অনুসারে। শুধু তাই নয়, ড্রেজিং করা পলি দূরে ফেলতে সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে সেগুলো কাছাকাছি দূরত্বে আবার নদীতে ফেলায় এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও ড্রেজিং শেষ হলে সুফল পাওয়া যাবে বলছে কর্তৃপক্ষ। সড়ক পথের চেয়ে নৌপথে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনের ভাড়া তুলনামূলক কম। নদী বেষ্টিত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে নৌ পরিবহন অনেক সহজসাধ্য। কিন্তু দিন দিন নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নৌপথ। ছোট নৌযান চলাচলে তেমন সমস্যা না হলেও ঢাকা থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বড় নৌযানগুলোকে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মেঘনার মিয়ারচর পয়েন্টের সমস্যা বিশাল আকার ধারণ করেছে।

বরিশাল জেলার সীমানা হিজলা থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মেঘনা নদীর প্রায় ৩ কিলোমিটারজুড়ে অসংখ্য ডুবোচর পড়ায় ভাটার সময় নাব্য সংকটের কারণে বড় নৌযানগুলো সেখানে আটকে যাচ্ছে। ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষা করতে হচ্ছে নৌযানগুলোকে। এতে সময় এবং অর্থের অপচয় হচ্ছে। যাত্রীরা নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। এমন অবস্থায় কর্তৃপক্ষ মেঘনার মিয়ারচর পয়েন্টে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ড্রেজিং করতে গেলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তখন ড্রেজিং করতে পারেনি। দ্বিতীয় দফায় অক্টোবরের মাঝামাঝি আবারও মিয়ারচর পয়েন্টে ড্রেজিং শুরু হয়। গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে সেখানে বিআইডব্লিউটিএ তাদের ৩টি নিজস্ব ড্রেজার এবং জনবল দিয়ে ড্রেজিং করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নৌ পথের ওই অংশ ঝুঁকিমুক্ত হয়নি।

ড্রেজিং কাজে নিয়োজিত বিআইডব্লিউটিএ’র কেন্দ্রীয় ড্রেজিং বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানা জানান, খালি চোখে তাকালে মেঘনা নদীর একপাশ থেকে অপর কিনারাও স্পষ্ট দেখা যায় না। এত বড় নদীর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ডুবোচর। বিশেষ করে মিয়ারচর পয়েন্টের যে চ্যানেল দিয়ে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নৌযানগুলো চলাচল করে সেই চ্যানেলের দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রেজিং চলছে। প্রথম পর্যায়ে ওয়ানওয়ে অর্থাৎ একটি বড় নৌযান চলার জন্য নদীর ওই পয়েন্টে ১২০ ফিট প্রশস্ত এবং ১২ ফিট গভীরতায় চ্যানেল খনন করা হয়েছে। পুরো চ্যানেলটি ২৪০ ফিট প্রশস্ত এবং কমপক্ষে ১২ ফিট গভীরতায় ড্রেজিং চলছে। ওই চ্যানেল থেকে মোট ৩ লাখ ঘনমিটার পলি ড্রেজিং করা হবে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পুরো চ্যানেলটি খনন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানা। তবে এই নৌপথে চলাচলকারী বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ এমভি সুন্দরবন-১০ এর প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. মজিবর রহমান বলেন, সমস্যা হওয়ার আগে থেকেই তারা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলেন। তখন বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানকে মিয়ারচর চ্যানেলে ৫০০০ ফিট দীর্ঘ, প্রায় ২৫০ ফুট প্রশস্ত এবং ভাটার সময় ১৫ ফিট গভীর করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এখন ড্রেজিংয়ের নামে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। মাস্টার মজিবর রহমান আরও বলেন, এখনো ওই চ্যানেলের দুই প্রান্তের প্রবেশ মুখে বড় বড় জাহাজগুলো আটকে যাচ্ছে। জাহাজগুলো পাশে কিংবা নদীর তলদেশে ঠেকে গেলে যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জাহাজও ঝুঁকিতে পড়ে। এমনকি চ্যানেলে ঠিকভাবে বয়া দিয়ে মার্কিংও করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। এই রুটের পারাবত লঞ্চের প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. শামীম আহম্মেদ বলেন, মিয়ারচর চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলে নৌযানগুলোকে অতিরিক্ত ২ ঘণ্টার পথ ঘুড়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি জাহাজের প্রতি ট্রিপে অন্তত ১০ ব্যারেল জ্বালানি বেশি লাগবে। এতে সময় এবং অর্থের প্রচুর অপচয় হবে।

মাস্টার শামীম বলেন, প্রতিনিয়ত পলি জমে নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ নদীর পলি ড্রেজিং করে ফের নদীতে ফেলায় এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না।  নদীর পলি ড্রেজিং করে ফের নদীতে ফেলা কর্তৃপক্ষের তামাশা এবং লুটপাটের কৌশল বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নৌযান মাস্টার।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি বরিশাল চেম্বারের সভাপতি আলহাজ মো. সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, নদী না বাঁচালে দক্ষিণাঞ্চল বাঁচবে না। তাই যে কোনো মূল্যে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ সচল রাখতে হবে। নৌপথকে সড়ক পথের মতো গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মিয়ারচর চ্যানেল প্রত্যাশা অনুযায়ী ড্রেজিং হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষও ড্রেজিং কার্যক্রম ভালোভাবে তদারকি করছে না। কেন্দ্রীয় দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আরও তদারকি প্রয়োজন। গভীরতা কম হওয়ায় ড্রেজিংয়ের পরও প্রতিনিয়ত লঞ্চগুলো নদীর তলদেশে ঠেকে যাচ্ছে। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে নৌযান চালানো সম্ভব নয়। তিনি নৌপথ সচল রাখতে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

নদীর পলি ড্রেজিং করে ফের নদীতে ফেলার বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র কেন্দ্রীয় ড্রেজিং বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানা জানান, নদীর যে পয়েন্টে ড্রেজিং চলছে, সেখান থেকে নদীর দুই তীর (পাশ) অন্তত ৩ কিলোমিটার দূরে। সে াতের কারণে ড্রেজিং করা পলি নদীর তীরে ফেলার জন্য দীর্ঘ পাইপ লাইন করা যাচ্ছে না। তাই এত দূরে ড্রেজিং করা পলি ফেলা অসম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর