শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সর্ববৃহৎ জুমায় লাখো মুসল্লি

বিশ্ব ইজতেমায় কাল আখেরি মোনাজাত

মোস্তফা কাজল, খায়রুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন, টঙ্গী থেকে

সর্ববৃহৎ জুমায় লাখো মুসল্লি

বিশ্ব ইজতেমায় গতকাল জুমার নামাজে অংশ নেন লাখো মুসল্লির —রোহেত রাজীব

ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অংশগ্রহণে এবং পুলিশ-র‍্যাবের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে তিন দিনের ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। গতকাল ফজর নামাজের পর জর্ডানের মাওলানা হায়াত ওমর খুরতির আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এদিকে এদিন দেশের সর্ববৃহৎ জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে ইজতেমা ময়দানে। বৃহত্তর এই জুমার নামাজের ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের হোসেন। কয়েক লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জুমার নামাজে অংশ নিতে ইজতেমায় যোগদানকারী ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, গাজীপুরসহ আশপাশের লাখো মুসল্লি ইজতেমাস্থলে সমবেত হন। জুমার জামাত ইজতেমা মাঠের সুবিশাল প্যান্ডেলের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে চার পাশের সড়কেও। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে ইজতেমা অভিমুখে। এ ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে বিপুলসংখ্যক মুসল্লি এ বৃহৎ জুমার নামাজে শরিক হন। জুমার নামাজে অংশ নিতে আগে থেকেই অনেকে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকায় আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান নেন। ইজতেমা সূত্রে জানা যায়, এবার বাংলার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় মূল বয়ান তরজমা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের ৭৯টি দেশের ৩ হাজার ৯১৯ জনসহ প্রায় ১৪/১৫ লাখ মুসল্লি অংশ নিচ্ছেন। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ১৭ জেলার মুসল্লিরা ১৭ প্রবেশ পথে ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। প্রথম পর্বে পুরো ময়দানকে ২৮টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। আর বিদেশি মুসল্লিদের জন্য ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোনায় নিবাস তৈরি করা হয়েছে। পুরো ময়দানের চারপাশে ৪১টি সিসি ক্যামেরা ও ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মনিটরিং করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতেই কনকনে শীত উপেক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি। অবশ্য গতকাল ফজর নামাজের পরও অনেককে ইজতেমায় যোগ দিতে দেখা যায়। লাখো কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান। আগামীকাল আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্বের আয়োজন। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে ফের শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুই পর্বের যত আয়োজন। গতকাল ইজতেমা মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, আগত মুসল্লিদের আল্লাহু আকবার ধ্বনি ও জিকির-আসকারে ভারি হয়ে উঠেছে টঙ্গী-উত্তরার আকাশ-বাতাস। তুরাগ তীরের যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা গেছে শুধু সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা মানুষের ভিড়। গতকাল জুমার নামাজের সময় শেষ মুহূর্তে নিরাপত্তাব্যবস্থা যাচাই করে নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তৎপর দেখা গেছে। ইজতেমা মাঠের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার টহল জানান দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি। গতকাল ইজতেমা মাঠে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকসহ দেশের অনেক বিশিষ্টজন জুমার নামাজ আদায় করেন। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম. এ মান্নান, ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি আবু কালাম সিদ্দিক ও জেলা পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে স্পিকার ও মন্ত্রী সাধারণ মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

আজ (শনিবার) ইজতেমার দ্বিতীয় দিন। গতকাল সকাল থেকেই সর্বস্তরের মুসলমানরা জুমার জামাতে শামিল হওয়ার জন্য টুপি, পাঞ্জাবি পরে জায়নামাজ হাতে ইজতেমা মাঠের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। দেশ বিদেশের অগণিত মুসল্ল্লির সঙ্গে একই জামাতে শরিক হন। এ ছাড়া নামাজ আদায় করার মাধ্যমে শিশু কিশোর থেকে সব বয়সী মানুষের সমাবেশ ঘটে গতকালের জুমার জামাতে। টঙ্গী, উত্তরা, কামারপাড়া, মিরপুর, আবদুল্লাহপুর প্রভৃতি এলাকার মসজিদে মসজিদে গতকালের জুমার জামাতে মুসল্ল্লি সংখ্যা ছিল খুবই কম।

ইজতেমা মাঠে জুমার জামাত সুবিশাল প্যান্ডেলের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে চার পাশের সড়কেও। এছাড়া বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশ থেকে গতকালও দিনভর মুসল্ল্লিদের টঙ্গীমুখী স্রোত অব্যাহত থাকে। কাঙ্ক্ষিত প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত এ স্রোত প্রবল থাকবে। তুরাগ তীরবর্তী বিশাল প্রান্তরে নির্মিত পাটের চট ও লাইলন কাপড়ের প্যান্ডেল ইতিমধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে যারা আসছেন তাদেরকে নিজ উদ্যোগে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নিতে হচ্ছে। গত দুদিনে শীতের তীব্রতা বেশি হওয়ায় মুসল্ল্লিদের কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে।

যারা বয়ান করেন : বাদ জুমা বয়ান করেন মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন, বাদ আসর মাওলানা আবদুল বারী ও বাদ মাগরিব মাওলানা রবিউল হক।

বয়ানে যা বলা হয় : গরিরেব জন্য ঈদের নামাজের পর অতি উত্তম ইবাদত হলো শুক্রবারের জুমার নামাজ। এদিনে আল্লাহ্র কাছে যে যা চাইবে, আল্লাহ তা তাকে দেবেন। জুমার নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে ওজু-গোসল করে মসজিদের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর থেকে তার আমলনামায় নেকি লেখা শুরু হয়ে যায়। বলা হয়, আমরা যা করব আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যই করব। আল্লাহ পাকের হুকুম মতো আমরা যেন সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে বাদ জুমার বয়ানে বলা হয়, পৃথিবীতে যেদিন থেকে ইমানদারি চলে যাবে সেদিন থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর নানা স্তর ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ এমনই করে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র আল্লাহই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে ইমানের মূল্য অনেক বেশি। ইমানকে মজবুত করতে হলে আমাদেরকে দাওয়াতী কাজে সময় লাগাতে হবে।

ছুটি ঘোষণা : কাল আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে টঙ্গীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

২০ পকেটমার ও ছিনতাইকারী গ্রেফতার : টঙ্গী মডেল থানা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশ থেকে প্রায় ২০জন পকেটমার ও ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়া জুমার নামাজ আদায় করার সময় এবং নামাজ শেষে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পকেটমারদের হাতে মুসল্লিদের কমপক্ষে ৩০টি মোবাইল  সেট চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় আইন প্র্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬ জন পকেটমার গ্রেফতার হয়।

১০ কিলোমিটার যানজট : গতকাল জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য কয়েক লাখ মুসল্লির সমাগম হওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কালিগঞ্জ সড়ক ও আশুলিয়া-সাভার সড়কে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বাস, মিনিবাস, ট্রাক, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলো এ সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকে। কয়েক সড়ক প্রায় আধ ঘণ্টাখানেক বন্ধ থাকে। ফলে ইজতেমায় আসা লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এ সময় হেঁটে ইজতেমাস্থলে আসেন। তীব্র যানজটের কারণে অনেক মুসল্লিকে অহেতুক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে বঙ্গভবন থেকে শরিক হবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গণভবনের বাসা থেকে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে এবং জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রত্তশন এরশাদ গুলশানের বাসা থেকে আখেরি মোনাজাতে শরিক হবেন বলে জানা গেছে।

আট মোবাইল কোর্ট : ইজতেমাস্থল ও আশপাশের অঞ্চলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণসহ ইজতেমার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রতিদিন দুই পালায় চারটি করে আটটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন।

দুই মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেওয়া দুই মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন আজিজুল হক (৬০) ও আবদুল মান্নান (মনা)। আজিজুল হকের বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার হবিষপুর গ্রামে। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে টঙ্গী হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। গতকাল ভোরে টঙ্গির বিশ্ব রোড পারাপারের সময় গাড়ি চাপায় মারা যান আবদুল মান্নান। গতকাল ফজরের নামাজের পর ইজতেমা ময়দানে তাদের দুজনের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

বিকল্প সড়ক ও পার্কিং : গাজীপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দুই পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়ার জন্য গাজীপুর জেলার চান্দনা চৌরাস্তা হতে মুসল্লিরা হেঁটে ইজতেমা ময়দানে যাতায়াত করবেন। এ কারণে ১৪ ও ২১ জানুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা হতে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত ভোর ৬টা থেকে আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এ ছাড়াও কালীগঞ্জ-টঙ্গী মহাসড়কের মাজুখান ব্রিজ থেকে টঙ্গী স্টেশন  রোড ওভার ব্রিজ পর্যন্ত এবং কামারপাড়া ব্রিজ থেকে মুন্নু  টেক্সটাইল মিল গেট পর্যন্ত সড়ক বন্ধ থাকবে। ইজতেমা চলাকালীন জয়দেবপুর চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে আগত মুসল্লিদের বহনকারী যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য আজ (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টা হতে উল্লিখিত মহাসড়কগুলো পরিহার করে টঙ্গীর কাদেরীয়া টেক্সটাইল মিল কম্পাউন্ড, শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি মাঠ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ, চান্দনা চৌরাস্তা হাইস্কুল মাঠ, জয়দেবপুর  চৌরাস্তা ট্রাকস্ট্যান্ড এবং নরসিংদী কালীগঞ্জ হয়ে আগত মুসল্লিদের বহনকারী যানবাহন টঙ্গীর কেটু (নেভি) সিগারেট ফ্যাক্টরি সংলগ্ন খোলা জায়গায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা হয়ে ঢাকাগামী যানবাহন জয়দেবপুর থানাধীন চান্দনা চৌরাস্তা হতে টঙ্গী হয়ে ডিএমপি এলাকায় প্রবেশের পরিবর্তে জয়দেবপুর চৌরাস্তা,  কোনাবাড়ী, চন্দ্রা ত্রিমোড়, বাইশমাইল, নবীনগর, আমিন বাজার হয়ে চলাচল করার জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর