শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বেহাল দুই সড়ক কাহিনী

কুষ্টিয়ায় মহাসড়ক সংস্কার নিয়ে হরিলুট কারবার

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

‘ভাইজান লালন শাহ সেতু পার হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ঢুকে কয়েক কিলোমিটার আসলেই যেন কেয়ামত নাজিল হয়। ভেড়ামারার ১১ মাইল থেকেই ভোগান্তি শুরু হয়, আর তা চলে কুষ্টিয়ার শেষ সীমানা পর্যন্ত। আগের দিনে গরুর গাড়ি চলার মাটির রাস্তাও এর চেয়ে ভালো ছিল। শুনেছি কুষ্টিয়াতে হানিফ আর ইনু সাহেবের বাড়ি, সেই জেলার রাস্তা এমন হয় কী করে?’ কথাগুলো রাজশাহী থেকে বরিশালগামী তুহিন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসচালক মো. গামার। গত বৃহস্পতিবার দিন-রাতে এই সড়কে ৬টি গাড়ি বিকল হয়। এর জেরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে তাকে। তখনই কথা হয় গামার সঙ্গে। সড়কের এই চিত্র শুধু ভেড়ামারায় নয়। কুষ্টিয়ার দুই মহাসড়কেরই একই দশা। আর প্রতিদিনই এই দশার শিকারে পরিণত হচ্ছে হাজার হাজার যানবাহন। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের ৩২ জেলায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগের একমাত্র পথ কুষ্টিয়া-পাবনা ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক। সড়ক বিভাগের হিসাবে, এই মহাসড়কে প্রতিদিন ১১ হাজারেও বেশি যানবাহন চলাচল করছে। কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক কুষ্টিয়া অংশ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের বুকজুড়ে শুধু বড় বড় গর্ত খানাখন্দ। বিশেষ করে কুষ্টিয়া শহরের বারখাদা ত্রিমহোনী থেকে শুরু করে ভেড়ামারা ১১ মাইল পর্যন্ত এবং শহরের মজমপুর গেট থেকে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব এলাকায় সড়কের প্রায় বেশিরভাগ কার্পেটিং ও ইট খোয়া উঠে গেছে। দেখে  বোঝার উপায় নেই, এটা দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক। প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছেন এই সড়কে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঘটছে প্রাণহানি।

এ সড়কে কথা হয় বাসচালক আমির হোসেনের সঙ্গে। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাই এসব নামেই জাতীয় মহাসড়ক, আসলে এই রাস্তার কোনো মা-বাপ নেই। সকালে গাড়ি নিয়ে বের হই। রাস্তার যে অবস্থা, তাতে দিন শেষে বাড়ি ফিরতে পারব কিনা ঠিক থাকে না। জান হাতে করে গাড়ি চালাতে হয়।’ ট্রাকচালক আইয়ুব আলী বলেন, ‘এই রাস্তায় গাড়ি চালানো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ভাঙা রাস্তার কারণে গাড়ির খুব ক্ষতি হচ্ছে। ভাড়া মেরে যা পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই গাড়ি মেরামতে খরচ হয়ে যাচ্ছে।’ অভিযোগ অনুযায়ী, মোটা টাকা খরচ দেখিয়ে প্রতি বছরই এ সড়কে সংস্কার কাজ করা হয়। মাত্র মাস খানেক আগেও সড়কের বিভিন্ন অংশে সিলকোড দেওয়া হয়। কিন্তু এখন তার কোনোই চিহ্ন নেই। এসব কাজেও প্রায় অর্ধকোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেছে। জানা গেছে, কদিন আগেই কুষ্টিয়ায় রাষ্ট্রপতির সফর উপলক্ষে এই সড়কের কুষ্টিয়া থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অংশের সংস্কারে প্রায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি করে কাজও করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তবে রাষ্ট্রপতি সফর শেষে ঢাকায় ফিরে যেতে না যেতেই সড়ক আগের অবস্থায় চলে গেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২ বছরে কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক সংস্কারে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ গত কয়েক মাস আগেও এ দুটি মহাসড়ক সংস্কার করা হয়। এ ছাড়া জরুরি মেরামতের কাজ সারা বছর লেগেই থাকছে। এত অর্থ ব্যয় করার পরও দুই মহাসড়কের এমন ভয়াবহ অবস্থা হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ রয়েছে যানবাহন চালক ও সাধারণ মানুষের। এ ব্যাপারে কথা হয় বরিশালের ট্রাকচালক হাফিজ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাই শর্ষের ভিতর ভূত আছে, তা না হলে এত টাকা খরচের পর মাত্র কদিনেই রাস্তার এমন দশা হতো না।’ জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান লাকী বলেন, ‘টেন্ডার হয়, কাজ হয়। কিন্তু সড়কের চেহারার পরিবর্তন হয় না। কাজে অনিয়মের কারণেই কয়েক মাস না যেতেই যা ছিল তাই হয়ে যাচ্ছে। ভারী যানবাহনের ভার নিতে পারছে না সড়ক। দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। স্থায়ী সমাধান না হলে জনদুর্ভোগ বাড়বে, আর সরকারের অর্থও এভাবে গচ্ছা যেতে থাকবে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক প্রকৌশলী বলেন, ‘টেন্ডার আহ্বানের পর যেসব ঠিকাদার কাজ পান, তারা শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারেন না। তারা স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকা স্থানীয় ঠিকাদারদের কাছে কাজ সাব কন্ট্রাক্ট দিতে বাধ্য হন। সাব কন্ট্রাক্টে কাজ বাগিয়ে নেওয়া এসব ঠিকাদারের বড় রাস্তার কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, নেই নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। এ কারণে রাস্তা সংস্কার করা হলেও তা বেশিদিন টেকে না।’ কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর অতি বৃষ্টিতে এই মহাসড়ক দুটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই অনুযায়ী সরকারি বরাদ্দ আসেনি। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি সড়কটি ঠিক রাখার জন্য। এরই মধ্যে এই সড়ক সংস্কারের জন্য ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আগামী মার্চ মাস নাগাদ কাজ শুরু হবে।’

সর্বশেষ খবর