মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১৩৬

মা প্রমাণ করলেন পরিকল্পিত খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

মা প্রমাণ করলেন পরিকল্পিত খুন

ভোররাতে কলিং বেলের শব্দ। এ সময় আবার কে এলো? বিছানায় শুয়ে আকতার হোসেন বিড়বিড় করছেন। ছেলে জাহিদকে ডাকেন তিনি। ‘এই জাহিদ, দেখ তো কে কলিং বেল বাজাচ্ছে।’ কিন্তু জাহিদের কোনো সাড়া নেই। পাশ থেকে উঠে জাহিদের মা জাহেদা আক্তার বলেন, ‘কী হলো তোমার! অনেক রাতে ঘুমিয়েছে ছেলেটা। ওকে ডাকছ কেন? আমি যাচ্ছি।’ জাহেদা আক্তার দরজা খুলে দেন। ছেলে জাহিদের পরিচিত দুই যুবক দরজার সামনে দাঁড়ানো। ‘খালাম্মা জাহিদ কোথায়?’ একজন প্রশ্ন রাখেন। জাহেদা আক্তার বলেন, ‘কেন? জাহিদ তো ঘুমাচ্ছে। ওর রুমেই আছে। কেন, ওকে কী দরকার এই সময়ে!’ ‘না মানে, আমরা তাহলে কী শুনলাম?’ বলেন আরেক যুবক। জাহেদা আক্তার বলেন, ‘কী শুনলা বাবা।’ ‘আমরা শুনলাম খারাপ খবর। দেখেন তো খালাম্মা জাহিদ রুমে আছে কিনা?’ যুবকদের একজনের কাছে শেষ লাইনটি শুনে ধাক্কা খান জাহেদা। তিনি দৌড়ে ছেলের রুমে যান। কিন্তু ছেলে তো রুমে নেই! জাহেদা ছেলের নাম ধরে ডাকেন। ‘জাহিদ! তুই কই?’ কোনো সাড়া নেই। বাথরুমে গেল কিনা দেখতে দৌড়ে যান জাহেদা। বাথরুমের দরজা খোলা। আরে! জাহিদ কোথায়? এ ঘর ও ঘর খুঁজতে থাকেন জাহেদা। নিজের রুম থেকে ছুটে আসেন আকতার হোসেন। শুনে তিনিও খোঁজাখুঁজি করেন। সেই দুই যুবক কী শুনে এসেছেন, তা জানতে চান জাহিদের বাবা, মা। তারা জাহিদের বাবা, মাকে হাসপাতালে যেতে বলেন। তারা শুনে এসেছেন, মধ্যরাতে নাকি ছাদ থেকে পড়ে গেছে জাহিদ। তাকে লোকজন নিয়ে গেছে হাসপাতালে। এ কথা শুনেই চিৎকার করে কান্না করতে থাকেন জাহেদা। তিনি বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। আকতার হোসেন আর জাহেদা আক্তার সন্তানের খোঁজ নিতে ছুটতে থাকেন হাসপাতালের দিকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে খোঁজ করেন জাহিদের। কিন্তু সেখান থেকে বলা হয়, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওপর থেকে পড়ে যাওয়ায় তার হাড়গোড় ভেঙে গেছে। থেঁতলে গেছে শরীরের বিভিন্ন স্থান। কিন্তু বাঁচেননি জাহিদ। চার দিন পর হাসপাতালে মারা যান। ট্রলিতে রাখা লাশ ধরে বাবা, মার গগনবিদারী চিৎকার। সন্তান হারিয়ে দিশাহারা তারা। জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করে তারা জানতে পারেন, মধ্যরাতে নিয়ে আসা হয়েছিল জাহিদকে। বহুতল ভবন থেকে পড়ে আহত অবস্থায় আনা হয়। অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। কিন্তু জাহিদের মা এ কথা বিশ্বাস করেন না। তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার পোলারে মাইরা ফালাইছে।’ ঘটনাটি ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতের। ১৮/১৯ গণকটুলি লেনের বহুতল ভবনের নিচ থেকে জাহিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই বাসার একটি ফ্লাটে জাহিদরা থাকতেন। আকতার হোসেন ও জাহেদা আক্তার তাদের ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেন। তারা হাজারীবাগ থানায় গিয়ে মামলার কথা বলেন। কিন্তু পুলিশ সে সময় হত্যা মামলা নেয় না। বাধ্য হয়ে আকতার হোসেন একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর আদালতে মিলন, লালু মিয়াসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন জাহেদা আক্তার। আদালত থানাকে নির্দেশ দেয় প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। হাজারীবাগ থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। জাহিদকে খুন করা হয়েছে— এমন অভিযোগ বার বার করলেও পুলিশ তা আমলে নেয় না। নিজেদের মতো করে তদন্ত চালাতে থাকে। থানা পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে তারা বলে, ‘মধ্যরাতে বাসার সবার অজান্তে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে যান জাহিদ। একসময় পা ফসকে নিচে পড়ে গেলে মারাত্মক আহত হন। চার দিন পর তার মৃত্যু ঘটে।’ পুলিশের এমন প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হন আকতার হোসেন ও জাহেদা আক্তার। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা তদন্তের সংস্থা পাল্টে দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শুরু করে। ডিবি পুলিশ তদন্তের শুরুতেই পড়ে বিপাকে। থানা পুলিশের প্রতিবেদনে রয়েছে অপমৃত্যু, কিন্তু জাহিদের পরিবারের অভিযোগ এটি পরিকল্পিত হত্যা। কী করবে ডিবি তা বুঝতে পারে না। ডিবি পুলিশ প্রায় ১৪ মাস তদন্ত করে আদালতে অপমৃত্যু বলে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাহিদ পা ফসকে নিচে পড়ে আহত হন। পরে হাসপাতালে মারা যান।’ এমন এক পরিস্থিতিতে জাহিদের বাবাকে হত্যার হুমকি দেয় স্থানীয় কিছু যুবক। যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলেছেন জাহিদের বাবা, মা। এতে ভীতসন্ত্রস্ত আকতার হোসেন ২০১৫ সালের ১৭ জুন হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। এর পরও দমে যাননি জাহিদের মা। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে এলাকা থেকে সরে যান। বিভিন্ন স্থানে ধরনা দেন। ছেলে হত্যার বিচার দাবিতে সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। থানা ও ডিবি পুলিশের তদন্ত প্রত্যাখ্যান করে নিজের সন্দেহ ঠিক বলতে থাকেন জাহেদা আক্তার। এ অবস্থায় ডিবির প্রতিবেদনের ব্যাপারে নারাজি প্রদান করেন তিনি। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট মামলার পুনর্তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। মামলার তদন্ত দেওয়া হয় পিবিআই পরিদর্শক মনিরুল ইসলামকে। ঘটনার আড়াই বছর পর পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্ত শুরু করে। বেরিয়ে আসে আসল চিত্র। জাহিদের মা বলে আসছিলেন তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। পিবিআইও নিশ্চিত হয় জাহিদ ছাদ থেকে পড়ে মারা যাননি, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পিবিআই দুজনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। আসামিরা হলেন একই এলাকার বাসিন্দা মিলন ও লালু মিয়া। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। অভিযোগ রয়েছে, হত্যাকারীরা থানা ও গোয়েন্দা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে জাহিদ হত্যাকাণ্ডটি অপমৃত্যু বলে চালানোর চেষ্টা করে। মামলার বাদী জাহেদা আক্তারের অভিযোগ, আসামিরা প্রভাবশালী। পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে— ঘটনার দিন রাতে জাহিদ ও তার ছোট বোন নার্গিস বাসায় টিভি দেখছিলেন। রাত ১টার দিকে জাহিদকে ফোন করেন মিলন। কিন্তু জাহিদের মা ছেলেকে বাইরে যেতে নিষেধ করলে মিলন দ্বিতীয় দফায় আবার ফোন করেন। এরপর জাহিদ বের হয়ে যান। পরে জাহিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাসার অদূরে পাওয়া যায়। জাহিদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার সময় এলাকার লোকজন এগিয়ে এলেও প্রতিবেশী মিলন আসেননি। পিবিআইর তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযোগ পর্যালোচনা, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও দালিলিক সাক্ষ্যসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, আসামি মিলন (৩০) ও লালু মিয়া (৫০) রাতের আঁধারে জাহিদকে মারধর করে অজ্ঞান অবস্থায় গণকটুলি লেনের আবিদের বাসার গেটে ফেলে রাখেন। এ দুই আসামির বিরুদ্ধে বাদীর আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ জানায়, একজন লড়াকু মায়ের কারণেই ছেলের খুনিদের চিহ্নিত করা গেছে।

সর্বশেষ খবর