বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৩৮

পারিবারিক সিদ্ধান্তে খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

পারিবারিক সিদ্ধান্তে খুন

ছবের আলী। বয়স পঞ্চান্ন। বগুড়ার শেরপুরের একটি ইউক্যালিপটাস বাগানের একটি গাছে তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। খুব ভোরে পথচারীদের চোখে পড়ে ছবের আলীর ঝুলন্ত দেহ। এরপর মানুষের মুখে মুখে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। গলায় দড়ি বাঁধা ঝুলন্ত ছবের আলীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ ভিড় করে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞাস করে, কারও পরিচিত কিনা। ছবের আলীকে কেউ চিনতে পারেনি। তবে ঘণ্টাখানেক সময় পর এক নারী কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে সেই বাগানে। ততক্ষণে লাশ থানায়। সেই নারী থানায় যেয়ে লাশ ধরে আহাজারি করতে থাকেন। তিনি ছবের আলীর ছোট বোন রহিমা। লাশের সামনে থেকে কেউ তাকে সরাতে পারছিল না। কান্না করছিল আর বলছিল, ‘ও আমার ভাইগো, তুমি কই গেলা। আমারেও নিয়া যাওগো।’ এরপর আসে ছবের আলীর স্ত্রী-সন্তানেরা। ছবের আলীর বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়িয়া গ্রামে।

২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালে ছবের আলীর লাশ উদ্ধার হয়। আগের রাতে ছবের আলী নাটোরের সিংড়া উপজেলার লয়দাপাড়া গ্রামে তার ছোট বোন রহিমার বাড়িতে পারিবারিক বৈঠকে এসেছিলেন। ছবের আলী হঠাৎ বাসা থেকে বেরিয়ে যান। রাতে তার আর খোঁজ মেলেনি। সকালে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে মানুষিক অসুস্থতার কারণে সে আত্মহত্যা করেছে বলে ভাই-বোনেরা পুলিশকে জানিয়েছে। কিন্তু ছবের আলীর স্ত্রী এটি বিশ্বাস করেনি। তার ধারণা, এটি পরিকল্পিত হত্যা। কিন্তু থানায় মামলা হয় অপমৃত্যু। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু ছবের আলীর স্ত্রী মর্জিনা ঘটনার ১০ দিন পর আদালতে মামলা করেন। আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের জন্য শেরপুর থানায় আসে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। শেরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলহাজউদ্দিন তদন্ত শুরু করে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পায় পুলিশ। তাতে লেখা রয়েছে আত্মহত্যাজনিত। পুলিশের তদন্ত সেদিকেই যায়। পুলিশ আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলে, ছবের আলী আত্মহত্যা করেছে। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেয় মর্জিনা। আবারও তদন্তের নির্দেশ আসে আদালত থেকে। ফের প্রতিবেদন দেওয়া হয় আত্মহত্যা। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের বাইরে যেয়ে পুলিশ তদন্ত করে না। যে কারণে আগের প্রতিবেদনই বহাল থাকে। ছবের আলীর স্ত্রী মর্জিনা দমে যাননি। এর পেছনে তিনি রয়ে গেছেন। আবারও আদালতের কাছে আবেদন জানান। আদালত এবার দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে। পিবিআই নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ঘটনার তিন বছর ১০ মাস পর হত্যা রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হয়। আর এ ঘটনায় পুলিশ যা জানতে পারে, তাতে তারা হতবাক।

পিবিআই জানতে পারে, ১৭ বিঘা জমি নিয়ে আপন ভাই-বোনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল ছবের আলীর। সেই রাতে ছবের আলীকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় জমির বিষয়ে বৈঠক করবে বলে। রাতে তার স্বামী ফোনে বলেছে, ছোট বোন রহিমার বাসাতেই সে থাকবে। আলোচনা শেষ হয়নি। পরে সকালে জানাজানি হয় ছবের আলী আত্মহত্যা করেছে।

ছবের আলীর বোনের ছেলে রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করলে ফাঁস হয় ছবের আলীর মৃত্যুর রহস্য। রবিউল পুলিশকে বলে, পারিবারিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছে বড় মামাকে (ছবের আলী) খুন করার। এটা করা হলে সব জায়গা মা ও ছোট মামা মিলে দখল করতে পারবে। এ কারণে ঘটনার দিন কৌশলে বৈঠক করার কথা বলে শেরপুর থেকে মামা ছবের আলীকে নাটোরে নিয়ে আসি। এরপর রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। খুনটি আমরা এমন ভাবে করব বলে পরিকল্পনা নিয়েছি যেন, সবাই বুঝতে পারে এটি আত্মহত্যা। আমরা মামাকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরের একটি বাগানে নিয়ে যাই। সেই বাগানের ভিতরে একটি গাছে চড়িয়ে দেই একজনকে। সঙ্গে দড়ির একটি মাথাও দেই। তার দায়িত্ব থাকবে দড়িটা ডালের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিচে দিয়ে দেবে। তার আগে আমরা মামার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে দেব। গলায় দড়ি দিয়ে একজন আত্মহত্যা যেভাবে করে, ঠিক সেভাবেই আমরা খুনের ঘটনাটি ঘটিয়েছি। হত্যায় আমি, বাবা ছবির উদ্দিন ও ছোট মামা চান মিয়া ও আনছার আলী অংশ নেন। পরে হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালিয়েছি। রবিউলের এমন সাবলিল স্বীকারোক্তিতে পিবিআই কর্মকর্তারা হতবাক হয়েছেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকতার হোসেন জানান, তারা শুরু থেকেই সন্দেহ করছিলেন এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। কারণ আত্মহত্যা করলে একটি মানুষ অন্য উপজেলার একটি বাগানে যাবে না। আর বাড়ি থেকে বোনের বাড়ি যাওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। এটিও সন্দেহের আরও একটি কারণ। এ কারণে হত্যার রহস্য উদঘাটনের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ছবের আলীর বোনের ছেলে রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করলে ফাঁস হয় ছবের আলী খুনের ঘটনা। ঘটনার তিন বছরের বেশি সময় পর জানা যায়, ছবের আলী আত্মহত্যা নয়, তাকে খুন করা হয়েছিল।

 

সর্বশেষ খবর