শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অপার সম্ভাবনার চরফ্যাশন

নিজামুল হক বিপুল, চরফ্যাশন থেকে ফিরে

অপার সম্ভাবনার চরফ্যাশন

নদী আর সাগরঘেরা এক জনপদের নাম চরফ্যাশন। ভোলা জেলার একটি উপজেলা। কিন্তু আয়তনে দেশের অনেক জেলার চেয়ে বড়। জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরের দুর্গম এ উপজেলার আয়তন ১ হাজার ৪৪০ বর্গকিলোমিটার। দেশের এই দুর্গম জনপদ ঘিরে এখন অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। সাগর, বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, বছরজুড়ে দেশি-বিদেশি পাখির কলতান, সাগরে ডলফিনের উপস্থিতি, বিস্তৃত এলাকাজুড়ে খামারবাড়িসহ হালের ‘জ্যাকব টাওয়ার’ পর্যটকদের জন্য ঈর্ষণীয় এক স্থান। একবার চরফ্যাশনে পা রাখলে বার বারই মন ছুটে যেতে চাইবে দুর্গম এই জনপদে। সম্ভাবনার এই জনপদ ঘিরেই নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। জানা গেছে, চরফ্যাশন হবে বাংলাদেশের ‘বালি’। যেখানে বছরজুড়ে থাকবে পর্যটকের উপস্থিতি। পর্যটকের বিষয়টি মাথায় রেখেই একসময়ের অবহেলিত অথচ অপার সম্ভাবনার এ জনপদকে সাজানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি করা হচ্ছে হোটেল-মোটেল, কটেজ, রেস্ট হাউস, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক, ওয়াচ টাওয়ারসহ আরও অনেক কিছু। অদূর ভবিষ্যতে ক্যাবল কার দিয়ে সংযোগ স্থাপন করা হবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সাগরে জেগে ওঠা অপূর্বসুন্দর সব চরের। আর সব পরিকল্পনাই হচ্ছে চরফ্যাশনের পর্যটনশিল্পকে ঘিরে। ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরের জনপদ চরফ্যাশন। ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত জে এইচ ফ্যাশনের নামে নামকরণ হয় চরফ্যাশনের। এখানে প্রশাসনিক থানা গঠিত হয় ১৯৭০ সালে। পরে তা রূপান্তরিত হয় উপজেলায়। এত দিন এ জনপদে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া ছিল না। রাজধানী থেকে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। আছে সড়ক যোগাযোগও। তবে তা এখনো অনেক কঠিন ও দীর্ঘ যাত্রার। সংগত কারণেই দ্বীপজেলা ভোলার এ উপজেলাটি বরাবরই ছিল অবহেলিত। গত কয়েক বছরে এ জনপদের চেহারা পাল্টে গেছে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, উপজেলা সদরের সঙ্গে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের যোগাযোগ গড়ে তোলা সবই ঘটেছে গত আট-দশ বছরে। এখানকার সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধি উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের হাত ধরেই এমন পরিবর্তন এসেছে। সরেজমিন চরফ্যাশনের বিভিন্ন

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামগঞ্জে এখন আর কোনো কাঁচা সড়ক নেই। মূল সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি সবই পাকা করা হয়েছে। পিচঢালা এসব সড়ক দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটে চলছে যানবাহন, মোটরসাইকেল। অবহেলিত এ জনপদের করুণ চিত্রের বর্ণনা দিয়ে জ্যাকব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছিলেন, ‘প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের এ জনপদ পুরোটাই চরাঞ্চল তাই বিশেষ করে আমার সংসদীয় এলাকার লোকজন যাতে সহজে উপজেলা সদরে আসতে পারেন সেজন্য প্রতিটি চরের সঙ্গে উপজেলার সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এখন ৯০ শতাংশ সড়কই পাকা। বাকি ১০ শতাংশ সড়ক আগামী এক বছরের মধ্যে পাকাকরণ হবে।’ শুধু তাই নয়, এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমাতে তিনি গত কয়েক বছরে চরফ্যাশনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, দেওয়ানি আদালত ও যুগ্ম জেলা জজ আদালত নিয়ে এসেছেন। জ্যাকব জানান, নদীভাঙন রোধে তিনি ১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছেন চরফ্যাশনকে ঘিরে। যার কাজ চলমান। আর উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়নে এখন ১৫ কোটি টাকার কাজ চলছে।

চর কুকরি-মুকরি ঘিরেই হাতছানি দিচ্ছে সম্ভাবনা : চরফ্যাশন উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় সাগরঘেরা জনপদ চর কুকরি-মুকরি। এটি একটি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নেরই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। অনেকটা সুন্দরবনের আদলে গড়ে ওঠা বনই হয়ে উঠছে এখন পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। বনের ভিতর দিয়ে চলে গেছে ছোট ছোট খাল। সেসব খাল ধরে ট্রলার বা বোটে করে প্রবেশ করা যায় বনে। খাল থেকেই উপভোগ করা যায় বনের দুই পাশের সবুজ, সৌন্দর্য। আর বনের ভিতরে ঢুকলে দেখা মেলে হরিণের। দল বেঁধে হরিণ ছুটে চলে বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। আছে পাখির কলকাকলি। নদী মোহনায় অতিথি পাখিরা নিরাপদে নিশ্চিন্তে দল বেঁধে চষে বেড়ায়; যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এই চর কুকরি-মুকরিকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। ইতিমধ্যে চর কুকরি-মুকরিতে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন তিন তারকা মানের মোটেল। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে এ মোটেলটি নির্মাণ করা হয়েছে; যা আগামী ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের উদ্বোধন করার কথা। শুধু তাই নয়, ২৪ জানুয়ারি ওই মোটেলেই রাতযাপন করার কথা রাষ্ট্রপতির। চর কুকরি-মুকরিতে একটি ইকো পার্ক ও একটি বিনোদন পার্কেরও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। চর কুকরি-মুকরি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, ‘আমি সরকারিভাবে ও নিজ উদ্যোগে বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশে গিয়েছি। সেসব দেশের পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। তার পর থেকেই আমি চর কুকরি-মুকরি ও পুরো চরফ্যাশন নিয়ে স্বপ্ন দেখছি। একসময়ের দুর্গম এই জনপদকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নতুন গন্তব্য হিসেবে তৈরি করতে পরিকল্পনা নিয়েছি।’ তিনি জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তায় চর কুকরি-মুকরিতে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। নির্মাণ করা হবে বেড়িবাঁধও। পর্যটকরা যাতে এই জনপদে এসে কোনোরকমের সমস্যায় না পড়েন সে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে পর্যটকদের উপস্থিতির কারণে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে এলাকায়। জ্যাকব জানালেন, ইতিমধ্যে চরফ্যাশন শহরে ২২৫ ফুট উচ্চতার একটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি ২৪ জানুযারি রাষ্ট্রপতির উদ্বোধন করার কথা। তিনি বলেন, এখান থেকে সহজেই চরফ্যাশনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা। আর চরফ্যাশনকে আরও আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার কাজ চলছে। তিনি বলেন, এই জ্যাকব টাওয়ার শুধু চরফ্যাশনেরই নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্য একটি আইকনিক টাওয়ার। চরফ্যাশন আর মনপুরা উপজেলা নিয়ে সংসদীয় এলাকা।

এর মধ্যে চরফ্যাশন হচ্ছে আয়তনের দিক দিয়ে বিশাল। ২১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলায় ইতিমধ্যে ৪টি থানা স্থাপন করা হয়েছে। এখন চরফ্যাশনকে জেলা করার স্বপ্ন দেখছেন তরুণ এই জনপ্রতিনিধি। সংসদ সদস্য জ্যাকব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশের অন্তত ১৮টি জেলা আছে যেগুলো আয়তনের দিক থেকে চরফ্যাশনের চেয়ে ছোট।

সর্বশেষ খবর