শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সিনেমায় অভিনয় ও তাজমহল দর্শন

নারী-কিশোরী পাচারে নয়া টোপ

জিন্নাতুন নূর

বাংলাদেশ থেকে কম বয়সী মেয়েশিশু ও নারীদের পাচারের জন্য এবার নতুন ফাঁদ ফেলা হচ্ছে। টোপ হিসেবে মেয়েদের ভারতীয় চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া এবং তাজমহল দর্শনের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। পাচারকারীরা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কম বয়সী মেয়েদের মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে তাদের সঙ্গে কথা বলে এ টোপ দিচ্ছে। আর কম বয়সী মেয়েদের প্রলোভন দেখাতে সুদর্শন যুবকদেরও পাচারকারী চক্র দলে ভেড়াচ্ছে। পাচারের শিকার মেয়েদের সরাসরি পতিতালয়ে যেমন বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে কিছু মেয়েকে আবার ভারতের বিভিন্ন ড্যান্স বার, ম্যাসাজ পারলার, বিশেষ ধরনের ম্যাসাজ সেবার (আবাসিক বাড়িতে পরিচালিত) কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে। জোরপূর্বক যৌনকাজে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কাজে অস্বীকৃতি জানালে তাদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন, শরীরে দেওয়া হয় জ্বলন্ত সিগারেটের ছেঁকা। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউকলি নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে গত ডিসেম্বরে ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং : মোডাস অপেরান্ডি অব টটস অন ইন্দো-বাংলাদেশ বর্ডার’ (Human Trafficking:Modus Operandi of Touts on Indo-Bangladesh Border) শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২ হাজার ২২০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত আছে। এ ছাড়া জলসীমানা আছে ২৫৯ কিলোমিটার; যা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে মানব পাচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রুট। কলকাতা ছাড়াও ভারতের বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদে বাংলাদেশ থেকে নারী ও বিভিন্ন বয়সী মেয়েশিশু পাচার করা হচ্ছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মেয়েদেরও ভারতে পাচার করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, গত এক দশকে রোহিঙ্গা, বাংলাদেশিসহ ৫ লাখেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশুকে পশ্চিমবঙ্গে পাচার করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্তের পেট্রাপোল পয়েন্ট দিয়ে নারী-শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। এ ছাড়া যশোর ও সাতক্ষীরার সীমান্ত দিয়েও হচ্ছে মানব পাচার। দিনাজপুর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নওগাঁ থেকেও মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের একটি পাচারকারী সিন্ডিকেট ঢাকার পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছে যৌন পেশার জন্য কম বয়সী মেয়ের খোঁজ করে। আর ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, পাটনা, চেন্নাই, সুরাট, আগ্রা, রাইপুর, যোধপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কম বয়সী বাংলাদেশি মেয়ে ও নারীদের পতিতালয়ে ব্যবহারের জন্য এ দুই সিন্ডিকেট নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। উল্লেখ্য, ভারতের সোনাগাছি পতিতালয়ে থাকা ৯ হাজার পতিতার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়।

ওই গবেষণার কাজে পাচারের শিকার ৩৮ বাংলাদেশি মেয়ের সঙ্গে গবেষক দলের কথা বলার সুযোগ হয়; যাদের বয়স ১১ থেকে ২৩। এই মেয়েদের ভারতীয় পুলিশ উদ্ধার করে, পরে তাদের পশ্চিমবঙ্গের শেল্টার হোমে রাখা হয়। ভুক্তভোগী এই মেয়েদের অধিকাংশই পাচারকারী চক্রের ভালো চাকরির প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার হয়। এদের একজন আয়েশা (১৬)। বাংলাদেশ থেকে তাকে পাচার করে দেওয়া হয় ভারতের মুম্বাইয়ের একটি পতিতালয়ে। একই ভাবে ভোলার তাসলিমাকেও (১৫) ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে কলকাতায় পাচার করা হয়। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, মেয়েদের ভারতে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ ও তাজমহল ভ্রমণের ফাঁদ ছাড়াও উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে, ভালো চাকরির আশ্বাস দিয়ে এবং গৃহস্থালি কাজের কথা বলে পাচারের ফাঁদে ফেলা হয়। নদীপথে ইছামতি দিয়ে রাতের আঁধারে অমানবিকভাবে পশুর মতো এই নারী-শিশুদের নৌকা ভর্তি করে পাচার করা হচ্ছে। কিছু ভুক্তভোগীকে আবার সীমান্তের কাছেই কোনো একটি বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর নাম বদলে ভ্রমণসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজ সংগ্রহের জন্য পাচারের শিকার নারীদের ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন কোনো গ্রামের বাড়িতে দুই মাস পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। আর পুলিশের সন্দেহ এড়াতে মুসলিম মেয়ে-নারীদের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেওয়া হয়। জানা যায়, একটি বাংলাদেশি মেয়েকে সীমান্ত পার করতে পাচারকারীদের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নিরাপত্তারক্ষীদের ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। প্রতিটি মেয়েকে পাচারের জন্য মধ্যবর্তী সুবিধাভোগী পাচারকারী ব্যক্তি পান ৫০ হাজার ভারতীয় রুপি। কিন্তু এই মেয়েটিকেই দিল্লি ও আগ্রার কোনো পতিতালয়ে ২-৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে আশ্বস্ত রাখতে পাচারের শিকার মেয়েটির পরিবারকে পাচারকারী সিন্ডিকেট নিয়মিত টাকা পাঠায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর