রবিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১৪১

ঘোষণা দিয়েই দুই লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ঘোষণা দিয়েই দুই লাশ

সুখে শান্তিতে জীবন কাটছিল ব্যবসায়ী সাদিকুর রহমানের। স্ত্রী, তিন মেয়ে আর এক ছেলে এ নিয়েই তার পরিবার। বড় মেয়ে জাপানে পড়ালেখা করছেন। মেজ মেয়ে ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্রী। একমাত্র ছেলে ব্যবসা করছেন। মাঝেমধ্যে তাকে বিদেশ থাকতে হয়। ছোট মেয়ে স্কুলে পড়ে। আত্মীয়স্বজনরা তাদের আদর্শ পরিবার হিসেবেই মনে করেন।

সকালে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নাস্তা করেন সাদিকুর রহমান। এটা তার অভ্যাস। সেদিন এক টেবিলে বসে স্ত্রী আর দুই মেয়ে নিয়ে নাস্তা শেষে সাদিকুর রহমান নিজ ঘরে যান। দুই মেয়ে রুমা আর শান্তা (ছদ্মনাম) ড্রইংরুমে পেপার পড়ছিলেন। তাদের মা রোমানা নার্গিস তখনো খাবার টেবিলে। কলিং বেল বেজে ওঠে। রোমানা নার্গিস দরজা খুলে দেন। সামনে দাঁড়ানো দুই যুবক। রুবেল আর মিথুন। স্থানীয় বখাটে। সাতসকালে তাদের দেখেই ভয় পান রোমানা নার্গিস। বলেন, ‘কী চাও তোমরা?’ সাদিক সাহেবকে চাই— রুবেলের জবাব। ড্রইংরুম থেকে দুই বোন ততক্ষণে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তখন রুবেল ছোট বোনকে উদ্দেশ করে বলে, ‘এই যাও, তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে আসো।’ এ কথা শুনে ভয় পান মা আর দুই মেয়ে। ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে রুবেল আর মিথুন। ছোট মেয়ে শান্তা দৌড়ে তার বাবাকে ডেকে নিয়ে আসে। সাদিকুর রহমান ডাইনিংরুমে এসে দাঁড়ান। তার সামনে দাঁড়িয়ে রুবেল বলে, ‘আপনার মেয়ে শান্তাকে আমি বিয়ে করব। আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিন।’ এ কথা শুনে সবাই হতভম্ব। বলে কী এই ছেলে। ‘এই, তুমি কী বলছ এসব। বের হয়ে যাও এখান থেকে।’ রাগ হয়ে বলেন সাদিকুর। এতে রুবেল আর মিথুন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠল। দুই বোন ভয়ে নিজেদের রুমে চলে যান। এ সময় রুবেল সাদিকুর রহমানকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরের রুমে ঢুকে পড়ে। ছোট মেয়ে শান্তার হাত ধরে টেনে বাসা থেকে বের করার চেষ্টা করে। মিথুন বলে, ‘শান্তাকে আমাদের কাছে দিয়ে দেন। ঝামেলা কইরেন না।’ সাদিকুর রহমান বলেন, ‘কোথায় যাও, পাগলামি করো না।’ ঠিক তখনই রুবেল সাদিকুরের মাথায় গুলি করে। গুলিবিদ্ধ সাদিকুর মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন। ‘এই তুমি কী করলা’— রোমানা নার্গিস চিৎকার করে বলে সোফা থেকে ওঠেন। কিন্তু মিথুন তাকে জাপটে ধরে রাখে। তখন রুবেল তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। সাদিকুরের দেহের ওপর লুটিয়ে পড়েন রোমানা নার্গিস। চোখের সামনে বাবা-মায়ের ছটফট দেখে ভীষণ ভয় পান দুই বোন। দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান তারা। একপর্যায়ে বড় মেয়ে রুমা দোতলা থেকে নিচে নেমে সিকিউরিটি গার্ডকে বলেন খুনিদের আটকানোর জন্য। সিকিউরিটি দুই যুবককে জাপটে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু পিস্তল দেখালে তাদের ছেড়ে দেন। পরে স্থানীয়রা দুই যুবককে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ সাদিকুর ও রোমানা নার্গিসকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনাটি ২০১০ সালের ২৪ মার্চের। গুলশান কালাচাঁদপুর এলাকার একটি পঞ্চম তলা বাড়ির দোতলায় থাকতেন সাদিকুর রহমানরা। এ ঘটনার পর পুলিশ আসে। তদন্ত শুরু হয়। পুলিশ জানতে পারে স্থানীয় বখাটে যুবক রুবেল দীর্ঘদিন ধরে সাদিকুর রহমানের ছোট মেয়ে শান্তাকে উত্ত্যক্ত করছে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে শান্তাকে আটকে প্রেম নিবেদন করত। দিন দিন এমন পরিস্থিতিতে শান্তাও কোনো সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। যা সাদিকুর রহমানের পরিবারের কারও চোখে ধরা পড়েনি। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তারা কথা বলত বলেও পুলিশ জানতে পেরেছে। একপর্যায়ে ঘটনার তিন মাস আগে শান্তা জানতে পারে রুবেল ইয়াবায় আসক্ত। অপরাধ জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এর পর থেকে শান্তা রুবেলের কাছ থেকে সরে আসে। এতে রুবেল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে স্কুলে যাতায়াতের পথে শান্তাকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে শান্তা ঘটনাটি তার ব্যবসায়ী বাবা সাদিকুর রহমানকে জানায়। পরে শান্তাকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন বাবা-মা। এ সময় রুবেল কয়েক দফা বাড়িতে ঢুকে ব্যবসায়ী সাদিকুর রহমানকে তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রতিবারই রুবেল প্রত্যাখ্যাত হয়। ঘটনার দুই দিন আগে শান্তাদের বাসায় গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে এসেছিল সে। সেই হুমকির ৪৮ ঘণ্টা পর ২৪ মার্চ দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। যাওয়ার সময় রুবেল বলে যায়, ‘যাঃ, শেষ করে দিয়ে গেলাম।’

২৮ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঝালকাঠির গাবখানে দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে রুবেল, মিথুন ও রুবেলের দুলাভাই মহিউদ্দীন আজাদ ওরফে রাব্বীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এরপর হাই কোর্টে ভুয়া কাগজপত্র উপস্থাপন করে জামিন নিয়ে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগার থেকে বেরিয়ে যায় রুবেল ও মিথুন। ২০১১ সালের ৬ জুন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ আসামি রুবেল ও মিথুন চন্দকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। কিন্তু এখনো পুলিশ তাদের খুঁজে পায়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুবেল বিয়ে করেছে। যমজ সন্তানের বাবাও হয়েছে। শোনা যায়, মিথুন এখন কানাডায়। সাদিকুর রহমান বাংলাদেশ নার্সারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। গুলশান, বাড্ডা ও রামপুরায় বীথি নার্সারি নামে তার তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জে ফিশারি ব্যবসা রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর