সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলা শিখে ওরা পড়ে বাংলাদেশে

আড়াই শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে

মাহমুদ আজহার ও রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর থেকে ফিরে

বাংলা শিখে ওরা পড়ে বাংলাদেশে

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) ডিবিএমের ছাত্র আবদুল্লাহিল আদ্দা। তার মা বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছেন। মায়ের হাত ধরেই বাংলাদেশে আসা আদ্দার। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, মায়ের ইচ্ছাতেই ভেটেরিনারি নিয়ে পড়ছি। এক্ষেত্রে মায়ের পছন্দ সবুজ শ্যামল দৃষ্টিনন্দিত কোলাহলমুক্ত ও নিরিবিলি ক্যাম্পাস হাবিপ্রবি। শুধু আমি নই, বেশ কয়েকজন সোমালিয়ান ছাত্রছাত্রী হাজী দানেশে ভর্তি হয়েছেন। ভুটান থেকে আসা ইউগেন জানান, এ দেশের বৈচিত্র্যময় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার পাশাপাশি এ দেশের মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধুসুলভ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। নিরিবিলি ছায়াঘেরা প্রকৃতির মতো এই ক্যাম্পাসে নেই কোনো অস্থিরতা। সেশনজট না থাকায়ও আমাকে আকৃষ্ট করেছে। বাংলা ভাষাও শিখে নিয়েছি। শুধু আদ্দা বা ইউগেনই নন, তাদের মতো প্রায় আড়াই শতাধিক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীর পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে হাজী দানেশ। ভারত, নাইজেরিয়া, নেপাল, ইথিওপিয়া, ভুটান ও সোমালিয়া থেকে পড়াশোনা করতে বাংলাদেশে আসা পছন্দের শীর্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে নেপাল থেকেই এসেছেন ১৩০ জন শিক্ষার্থী। বাংলা ভাষাও অনেকেই রপ্ত করেছেন বেশ ভালোই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান অত্যন্ত ভালো। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা হয়। নিরিবিলি পরিবেশ ও অপেক্ষাকৃত রাজনীতিমুক্ত। সেশনজট নেই বললেই চলে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপসহ আনুষঙ্গিক আরও বেশ কিছু সুবিধাও রয়েছে। তবে তারা দুটি সংকটের কথাও তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে। প্রথমত, বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে এলে তাদের ভিসা জটিলতায় পড়তে হয়। তা ছাড়া হাবিপ্রবিতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকটও প্রকট। এই দুই সংকট কাটাতে পারলে হাজী দানেশে আরও বেশি বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসবে এখানে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনের মুখোমুখি হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ডক্টর সফিউল আলম। তিনি জানালেন, ‘ভিসা জটিলতার বিষয়টি দেখভাল করে দূতাবাস। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতটুকু সাহায্য সহযোগিতা করার দরকার আমরা করে থাকি। তবে আবাসিক সংকট রয়েছে। এটা দূর করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হবে। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের একটি উইংয়ে তাদের আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারেরও সহযোগিতা জরুরি।’ দিনাজপুর শহর হতে ১০ কিলোমিটার উত্তরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পশ্চিমে অবস্থিত ৮০ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হাবিপ্রবি। দিনাজপুরের কৃতী সন্তান ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হাজী মোহাম্মদ দানেশের নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। দিনাজপুর-রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন বাঁশেরহাট নামকস্থানে সুরম্য অট্টালিকা ও বহু প্রজাতির সবুজ বৃক্ষ ঘেরা এই দৃষ্টি নন্দন ক্যাম্পাসটি অবস্থিত। ২০০০ সালে বিএসসি এজি (অনার্স) প্রোগ্রামে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল একটি মাত্র অনুষদ ‘এগ্রিকালচার অনুষদ’ নিয়ে। বর্তমানে আটটি অনুষদের অধীনে ৪৪টি বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রী ১২ হাজারের অধিক। এর মধ্যে প্রায় আড়াইশ বিদেশি।

নেপাল থেকে আর্কিটেকচার-এ পড়তে আসা শিক্ষার্থী নিতি লামেক জানান, আমাদের কিছু সমস্যা হয় এখানে তার মধ্যে অন্যতম ইন্টারন্যাশনাল হল নেই। আর আমরা ভিসা সময়মতো পাই না। প্রথমে এক বছরের জন্য ভিসা পাই। পরে ভিসা বাড়ানোর সময় সহযোগিতা পাই না, তখন সময় কালক্ষেপণ হয়। তারপরও এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার পছন্দের। পড়াশোনার মান ভালো। একই দেশ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যায়ন করছেন ভরতি ইয়াদব। তিনি জানান, ‘এ অঞ্চলের আবহাওয়া, শিক্ষার মান ভালো তাই এখানে আমি পড়তে এসেছি।’ ডিভিএম বিভাগের ২য় বর্ষের অধ্যয়নরত মুকেশ ইয়াদব ও অঙ্কিত ঠাকুর বলেন, ‘নেপালের মহতারি জেলায় আমাদের বাড়ি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেপালের ১৩০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। আমরা কখনো বাংলাবান্ধা আবার কখনো ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। ভর্তির পর প্রথম বর্ষ একটু সমস্যা হলেও পরে বন্ধুদের সহযোগিতায় তা কেটে যায়। প্রথম দিকে ক্লাসে বাংলায় টিচিং হলে সমস্যা হয়। তবে প্রথম বর্ষে থাকতেই আমরাও কিছু কিছু বাংলা শিখে নিয়েছি।’ বিশ্ববিদ্যালয়টি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ডি-বক্সের সামনে রয়েছে বিশাল শহীদ মিনার চত্বর। সেখানে দেখা মেলে বেশ কিছু তরুণ তরুণীর। তাদের সঙ্গে আড্ডায় উঠে আসে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনের নানা স্বপ্নের কথা। এ ছাড়া আশপাশেই কেউ কেউ প্রেম-ভালোবাসা আর গল্প-আড্ডাতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সবুজ-শ্যামল। ছাত্র-ছাত্রীদের মননশীলতার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ক সাংস্কৃতিক জোট, রোটার‌্যাক্ট ক্লাব ডিবেটিং সোসাইটিসহ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করছে। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠক ফোরাম বন্ধু প্রতিদিনের হাবিপ্রবির শাখা জায়গা করে নিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে। শহীদ মিনার চত্বরে সেদিন আড্ডা বসেছিল বন্ধু প্রতিদিনের হাবিপ্রবির শাখার সদস্যদের। সংগঠনের তারিকুল ইসলাম বললেন, পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই শিক্ষার্থীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। মেধাবীরা এগিয়ে এলে এসব অঙ্গন যেমন সমৃদ্ধ হবে পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গনে নেতৃত্বের সৃষ্টি হবে। রোমান কথার একপর্যায়ে বললেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজ নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই এগিয়ে আসতে হবে। হাবিপ্রবির উপাচার্য  অধ্যাপক ড. মু. আবুল কাসেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখছেন কোথায় কম খরচে লেখাপড়ার মান ভালো। সেশনজট  নেই, অনুকূল আবহাওয়া। এসব বিবেচনা নিয়ে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছেন। দিন দিন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছেই। এবার ৬৭টি আবেদন এলেও আমরা যাচাই-বাছাই করে ৩৫ জন নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভিসা জটিলতাসহ বিমানবন্দরে আমরা সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে থাকি। এরপরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানের সময় তাদের দেখভাল ও সহযোগিতার জন্য একটি বিশেষ শাখা রয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এ সংকট দূর করতে এরই মধ্যে নতুন একটি হলের এবং গেস্ট হাউসের একটি ইউনিট তাদের দেওয়া যায় কিনা চিন্তাভাবনা চলছে। এ ছাড়াও বিদেশিদের একটি হল নির্মাণের জন্য মঞ্জুরি কমিশনে কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর