শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৪৩

মনের আগুন নেভাতে খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

মনের আগুন নেভাতে খুন

একটি ফ্ল্যাট বাসায় লাশ পড়ে থাকার খবর পেয়ে ছুটে যায় পুলিশ। ১৫ মিনিটের মধ্যে তারা হাজির হয় ওই ফ্ল্যাটে। ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় এক যুবকের লাশ। হাত-পা বাঁধা। মুখে স্কচটেপ। গোপনাঙ্গ অর্ধেক কাটা। পুরো ঘরে ছোপ ছোপ রক্ত। পুলিশ যুবকের প্যান্ট হাতড়ে কিছু কাগজ পায়। একটি পরিচয়পত্র খুঁজে পায়। পুলিশ জানতে পারে যুবকটির নাম ওমর ফারুক বাপ্পী (৩৭)। পেশায় আইনজীবী। পুুুলিশ খুনি চক্রকে খুুঁজতে কাজ শুরু করে। ঘটনাটি চট্টগ্রামের। গত বছর ২৫ নভেম্বর পুলিশ চকবাজার থানার মিয়ারবাপের মসজিদ এলাকার একটি বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে।

হত্যাকাণ্ডের শিকার ওমর ফারুক বাপ্পীর বাড়ি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চৌমুহনী গ্রামে। বাপ্পীর বাবা আলী আহমেদ ও মায়ের নাম মানোয়ারা বেগম। পুলিশ জানতে পারে, চট্টগ্রাম মহানগরের চকবাজার থানার কে বি আমান আলী রোডে বড়মিয়া মসজিদের সামনে একটি ভবনের নিচতলার যে বাসা থেকে আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর লাশ উদ্ধার করা হয়, সে বাসাটি দুই দিন আগে ভাড়া নিয়েছিলেন রাশেদা।

আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর সহকারী আসাদ খানকে জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডে রাশেদার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (মেট্রো) সন্তোষ কুমার চাকমা। তিনি জানান, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা রাশেদা বেগম ও তার স্বামী ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের এ ঘটনায় বাকলিয়া থানায় মাদকের মামলা হয়। ওই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রাশেদার সঙ্গে বাপ্পীর পরিচয়। একসময় ওই নারীকে জামিনে বের করে আনেন বাপ্পী। কিন্তু তার স্বামী তখন জামিন পাননি। সে সময় ওই নারীর সঙ্গে বাপ্পীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে কালামিয়া বাজার, চকবাজার ডিসি রোডসহ একাধিক বাসায় একত্রে তারা বসবাস করেন। এরই মধ্যে তারা বিয়েও করেন। গত বছরের শুরুতে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। তখন বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে দুজনই পাল্টাপাল্টি মামলা করেন। রাশেদা মারধরের অভিযোগ এনে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি বাপ্পীকে গ্রেফতার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিন পান তিনি। বাপ্পীর করা মামলায় রাশেদা ১৭ দিন জেল খাটেন। এরপর হঠাৎ করে আইনজীবী বাপ্পীকে ভণ্ড, প্রতারক, নারীলোভী উল্লেখ করে নগরীর বাকলিয়া, ডিসি রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় একটি পোস্টার চোখে পড়ে। পোস্টারে উল্লেখ করা হয়, বিনা পয়সায় যুবতী নারীদের মামলা পরিচালনার অভিনয় করে আইনজীবী বাপ্পী কখনো প্রেম, কখনো বিয়ের নামে নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেন। স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার পর ডিভোর্সের নথি গোপন করে সেই স্ত্রীর সঙ্গে আরও ছয়-সাত মাস রাতযাপন করেন বলে সেই পোস্টারে উল্লেখ করা হয়।

পোস্টারে স্ত্রী রাশেদা বেগম ও বাপ্পীর বিয়ের ছবি ছাড়াও গ্রেফতারের পর রশি দিয়ে বাপ্পীর কোমরবাঁধা ছবিসহ দুটি ছবি দেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়, রাশেদাই এই পোস্টারের মুদ্রণকারী। এর পরও রাশেদার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন বাপ্পী। রাশেদার জন্য প্রতি মাসে কিছু খরচও দিতেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, রাশেদা বেগমই বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) বড়মিয়া মসজিদের বাসাটি ভাড়া নেন, পরদিন রাত সাড়ে ৮টা থেকে শনিবার ভোরের মধ্যে কোনো একসময় সেই বাসায় গিয়ে খুন হন ওমর ফারুক বাপ্পী।

দুই দিনের মধ্যে আইনজীবী বাপ্পী খুনের ঘটনায় তার কথিত স্ত্রী রাশেদা বেগমসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রাশেদা বলেছেন, তার মনের আগুন নেভাতে খুন করেন বাপ্পীকে।

পিবিআই পরিদর্শক (মেট্রো) সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, রাশেদা ও হুমায়ুন নামে দুজনকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুপুরে নগরীর ইপিজেড এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে পিবিআইর কাছে তথ্য আছে।

পিবিআই সূত্র জানিয়েছে, ছয়জনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুরো টিমকেই ধরতে সক্ষম হয়েছে পিবিআই। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে।

খুনের ঘটনায় বাপ্পীর বাবা বাদী হয়ে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বাপ্পী খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি আকবর হোসেন প্রকাশ রুবেল (২৩)। এ নিয়ে তিনজন আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়ে খুনের দায় স্বীকার করলেন।

৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নাজমুল হোসেন চৌধুরীর আদালতে রুবেল জবানবন্দি দিয়েছেন। আরেক আসামি জাকির হোসেন প্রকাশ মোল্লা জাকিরকেও (৩৫) আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তবে জাকির জবানবন্দি দেননি। আদালত রুবেল ও জাকিরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে।

সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল জানিয়েছেন, তিনি ছোরা নিয়ে বাপ্পীকে যে বাসায় খুন করা হয়েছে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই বাপ্পীর পুরুষাঙ্গ কেটেছিলেন। বাপ্পীর স্ত্রী রাশেদা বলেছিলেন, ‘আমি যদি বাপ্পীকে না পাই, তাহলে কেউ যেন না পায় সেই ব্যবস্থা কর।’ তাদের ২০ হাজার টাকায় কন্টাক্ট করলেও ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকিতে খুন করিয়ে নেন রাশেদা।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে রুবেলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ছোরাটি উদ্ধারের কথাও জানিয়েছেন সন্তোষ কুমার চাকমা।

২৭ নভেম্বর ওই মামলায় ছয়জনকে আটকের কথা জানায় পিবিআই।

আটকের পরদিন ছয় আসামির মধ্যে আল-আমিন (২৮) ও মো. পারভেজ প্রকাশ আলী (২৮) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর