বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১৪৪

ফাইনাল বললেই পড়ত লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ফাইনাল বললেই পড়ত লাশ

ঝিনাইদহের দরিদ্র পরিবারের সন্তান টিপু সুলতান। দর্জি দোকানের সাধারণ এক কর্মচারী। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে পুরো পরিবার দিশাহারা। একবেলা খাবার জুটলেও অন্য বেলায়  উপোস। এ সময় চাচা রজব আলী টিপু সুলতানের পাশে দাঁড়ান। তিনিই ছিলেন অভিভাবক। টিপুকে স্নেহ করতেন সন্তানের মতোই। টিপুও তাকে বাবার মতোই ভালোবাসতেন। কোনোমতে জীবন কাটছিল তাদের। কিন্তু আবারও একটি ঝড় বয়ে গেল টিপুদের পরিবারে। তছনছ করে দেয় তাদের সংসার। পুলিশের সোর্স-এই অভিযোগে রজব আলীকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হত্যা করে। হত্যাকারীদের কয়েকজনকে টিপু চিনতেন। মামলাও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যায়নি। ১৯৮৩ সালের ঘটনা এটি।

অর্ধশিক্ষিত টিপু বুঝতে পারেন আইন তার পক্ষে নয়। তাই নিজের হাতেই আইন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চাচা হত্যার বদলা নিতে ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে টিপু যোগ দেন সর্বহারা পার্টির কামরুল গ্রুপে। এরপর দলবদল। যোগ দেন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল)। এরপর ইতিহাস রচিত হয় টিপু সুলতানকে নিয়েই। টিপু শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতেন ‘ফাইনাল’ শব্দটি। এর অর্থ প্রতিপক্ষকে খতম করে দাও। ফাইনাল শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে লাশ পড়ত। এভাবেই ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গারপাড়ার গ্রামের আমানত আলীর সহজ সরল ছেলে টিপু হয়ে উঠেছিলেন সন্ত্র্রাসের মহীরুহ হিসেবে। আতঙ্কের নাম ছিলেন টিপু সুলতান। পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না। মুখোমুখি হলেই বন্দুকযুদ্ধ হতো। বহুবার পালিয়ে গেছেন। অল্পের জন্য তাকে মিস করেছে পুলিশ।

পুলিশ ও অন্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল) যোগদানের পর টিপু একটি সামরিক স্কোয়াডের দায়িত্ব পান। তার ওপর দলের তরফে নির্দেশ ছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্য প্রতিপক্ষ গোপন দলগুলোকে নির্মূল করার। এই নির্মূল অভিযানে নেমে টিপু সাহসের পরিচয় দেন। তিনি তার চাচার সন্দেহভাজন চার হত্যাকারীকে ‘ফাইনাল’ করে দেন। হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ সদর, চুয়াডাঙ্গা সদর, কোটচাঁদপুর, শৈলকুপার একাংশে টিপুর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তৃত হয়। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি এবং পুলিশের সঙ্গে গোটা চল্লিশেক বন্দুকযুদ্ধের পরও টিপুর শক্তি এতটুকু কমেনি। চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ— এসব অপরাধের মধ্য দিয়ে তিনি পরিণত হন মূর্তিমান আতঙ্কে। শতাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার নাম যুক্ত হয়। হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে টিপুর নিজস্ব কিছু কৌশল ছিল। প্রথমে গুলি ও শেষে জবাই করে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করার কাজটি তিনি নিজ হাতে করতেই পছন্দ করতেন। টিপুর নৃশংসতায় গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালাতে থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঝিনাইদহ জেলার ১৮টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের ব্যবস্থা করে চরমপন্থি দমনে। তবে তাদের লক্ষ্য ছিল টিপুকে ধরা।

পুলিশ তাকে ১৯৯৩ সাল থেকে আটকের অভিযান শুরু করে। কিন্তু প্রতিটি অভিযানেই পুলিশের ঘেরাও ভেদ করে তিনি নিরাপদে স্থান ত্যাগ করতে পারতেন। এক পর্যায়ে টিপু কোণঠাসা হয়ে পড়েন। আশ্রয় নেন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা এলাকায়। পুলিশ এবার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল নেয়। তারা গোপনে যোগাযোগ করে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিরই সামরিক শাখার নেতা মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। কিন্তু টিপু তার শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জেনে যান বিষয়টি। জানতে পারেন, মোয়াজ্জেম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও তাকে বুঝিয়ে দলে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে তিনি ১৯৯৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যান আলমডাঙ্গা তিওরবিলা গ্রামে। মোয়াজ্জেম জানত তার সামনে পার্টির তরফে একটি সিদ্ধান্তই আছে। আর তা হলো ‘মৃত্যুদণ্ড’। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে মোয়াজ্জেম ওই রাতেই টিপুকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। তার এই হত্যার মিশন সাকসেস হয়। টিপুর লাশ পুঁতে রাখা হয় পার্শ্ববর্তী বিলে। টিপুর চার দেহরক্ষী নজরুল, বেল্টু, সাত্তার ও কাজলকেও হত্যা করে মোয়াজ্জেম। পরে অবশ্য টিপুর অনুগতরা হত্যার বদলা নিয়েছিল চুয়াডাঙ্গা সদরের বোয়ালমারী গ্রামের আপন দুই ভাই মনির ও দবিরকে ‘ফাইনাল’ করে। টিপুর লাশ ১৭ দিন পর পুলিশ উদ্ধার করে বিল থেকে। লাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না, টিপু খুন হতে পারেন। প্রিয় কমরেডদের হাতে টিপু প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন-সন্ত্রাসীদের জীবন শেষ হয় সন্ত্রাসের মাধ্যমেই। শতাধিক ব্যক্তিকে তাদের জীবন থেকে ‘ফাইনাল’ করতে গিয়ে নিজেকেও যে একদিন ‘ফাইনাল’ হতে হবে তা কখনো একবারও ভাবেননি টিপু। টিপুর পরিবারের কোনো সদস্য এখন ঝিনাইদহের হিঙ্গারপাড়া গ্রামে থাকেন না। টিপুর মা এখন ঢাকায় একটি বস্তিতে তার ছোট ছেলের কাছে থাকেন। সে কাজ করে ছোট একটি গার্মেন্ট কারখানায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর