বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৃষিযন্ত্রে হাজার কোটি টাকা

বদলে যাচ্ছে বগুড়া

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

কৃষিযন্ত্রে হাজার কোটি টাকা

দেশের কৃষিযন্ত্রে সম্ভাবনার আরেক নাম বগুড়া। উত্তরাঞ্চলের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দিনে দিনে গড়ে উঠেছে শতাধিক কৃষিযন্ত্রাংশের কারখানা। আর এই উৎপাদিত কৃষিযন্ত্রাংশ উত্তরাঞ্চলের তো বটেই, চাহিদা মেটাচ্ছে সারা দেশের। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। করতোয়া নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা এই বগুড়ায় রয়েছে এই অপার সম্ভাবনাময় কৃষিযন্ত্র শিল্প। এখানে তৈরি কৃষিযন্ত্র শিল্প রপ্তানিতে বদলে দিতে পারে উত্তরাঞ্চলের চিত্র। বদলে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা। সম্ভাবনা রয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও। বগুড়ার বিসিকে গড়ে ওঠা এই সম্ভাবনাময় শিল্প সঠিক তদারক করা হলে হাজার হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার। জানা গেছে, বগুড়ায় উৎপাদিত হাজার হাজার কৃষিপণ্য ব্যবহূত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিকাজে। এ ছাড়া বাসাবাড়ি, ছোট-বড় ইন্ডাস্ট্রি ও বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কল-কারখানায় ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশও তৈরি হচ্ছে এখানে। এর মধ্যে রয়েছে শ্যালো ইঞ্জিনের সেচ পাম্প, লায়নার, পিস্টন, টিউবওয়েল, পাওয়ার টিলারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, লেদ মেশিন, গাড়ির ব্রেক ড্রাম, করাতকল, ফ্লাওয়ার মিল, টেক্সটাইল মিল, অয়েল মিল, এমনকি ধানকাটা মেশিনসহ অন্যান্য মেশিনের যন্ত্রাংশ। এসব যন্ত্রাংশের ওপর দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। বগুড়া বিসিকের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার আগে থেকে জেলায় বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু হয়। বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় বিসিক শিল্প ও কাটনারপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় এই যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। একপর্যায়ে এ কারখানাগুলোতে তৈরি কৃষিপণ্য বগুড়াসহ উত্তরের ১৬ জেলায় ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি করে। এই চাহিদার কারণে বগুড়া বিসিকে শিল্পপ্লটের চাহিদা বাড়তে থাকে। ১৯৮০ সালে বগুড়া বিসিক শিল্পনগরীতে শিল্পপ্লট শেষ হয়ে যায়। পরে এ শিল্পের বিকাশ বেড়ে যাওয়ায় শহরের ফুলবাড়ী, গোহাইল রোড, রেলওয়ে মার্কেট, শাপলা মার্কেট, কাটনারপাড়া, চারমাথা এলাকায় গড়ে ওঠে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব কারখানায় তৈরি বিভিন্ন পার্টস ব্যবহূত হয়ে থাকে বাসাবাড়ি, ইন্ডাস্ট্রি ও কৃষিকাজে। দেশের কৃষিযন্ত্রাংশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের জোগানদাতা বগুড়ার ফাউন্ড্রি শিল্প। এ শিল্পের সঠিক তদারক করা হলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বগুড়ায় এ শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছে আশির দশকে। শুরুতে ছোট পরিসরে থাকলেও ক্রমেই বিকশিত হয়েছে। কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির মাধ্যমে ভাগ্য বদলেছে অনেকেই। ক্রমেই এ পেশার দিকে ঝুঁকছে মানুষ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে মেটাচ্ছে কৃষিযন্ত্রের চাহিদা। শহরের বিভিন্ন স্থানে ফাউন্ড্রি কারখানা থাকলেও রেলওয়ের পাঁচ একর জমিতে গড়ে উঠেছে এসব ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপ মালিকরা এক বছরের জন্য এই জমি ইজারা নিয়ে বাজার গড়েছেন। বগুড়া শহরের গোহাইল রোড, রেলওয়ে মার্কেট, জেলা পরিষদ মার্কেটসহ কয়েকটি এলাকায় শুধু কৃষিযন্ত্রাংশ তৈরি ও বিক্রির বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার শত শত ব্যবসায়ী কৃষিযন্ত্রাংশ ও যন্ত্র কিনতে আসেন। বগুড়ায় প্রায় ১০০ ফাউন্ড্রি ও এক হাজারের বেশি ওয়ার্কশপ রয়েছে। বগুড়া ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ না থাকলেও দেখে দেখে কাজ শিখেছেন তারা। চোখে দেখা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন কৃষিযন্ত্র। রেলওয়ে মার্কেটের শ্রমিকরা সেচপাম্প, ধান ও গম মাড়াই যন্ত্র, ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র, ডিজেল ইঞ্জিনের পিস্টন ও লাইনার, ইঞ্জিন ও মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ, পাওয়ার টিলার, সার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর, ট্রাক্টর, বীজ, কীটনাশক স্পেয়ার, ডাইকাস্টিং, সোলার প্যানেল, অটোরাইস মেশিন, ওয়াটার পাম্প, ডেইরি ইকুইপমেন্ট ও কেমোডিটি ফুড মেশিন তৈরি করেন। আর সেগুলো সরবরাহ করা হয় সারা দেশে। এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ অঞ্চল ঘোষণার দাবি ব্যবসায়ীদের। কামাল মেশিন টুলসের মালিক কামাল মিয়া বলেন, ফাউন্ড্রি ও কৃষি যন্ত্রপাতি শিল্প অনেক সম্ভাবনাময়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা চলে আসছে। কেউ কেউ উত্তরাধিকার আর নিজ উদ্যোগে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। ঋণ জটিলতা ও নিজস্ব জায়গার অভাবে অনেকটা খুঁড়িয়ে চলছে এ শিল্প। অবাধে বিদেশি কৃষিপণ্য আমদানি করা হচ্ছে। যদিও একই পণ্য দেশেই নির্মিত হচ্ছে। দেশে তৈরি কৃষিযন্ত্রই দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে দেশ। বগুড়া বিসিকের ফাউন্ড্রি শিল্প মিল্টন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আজিজুর রহমান মিল্টন জানান, আশির দশকে ব্যক্তি উদ্যোগে বগুড়াতেই প্রথম ফাউন্ড্রি শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। জেলায় ফাউন্ড্রি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬২টি। এর সঙ্গে আরও কিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর ফাউন্ড্রি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ার্কশপ রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজারের মতো। বগুড়ায় ফাউন্ড্রি শিল্পের ৮০ ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। এর মধ্যে ফাউন্ড্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ওয়ার্কশপ। শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ছোট-বড় কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলে যেমন এর প্রসার ঘটবে, তেমনি সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। সুমন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের জিল্লার রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে তৈরি পণ্য অন্য দেশের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। বিদেশি পণ্যের মতোই টেকসই।’ আরেক উদ্যোক্তা আইনুল হক সোহেল বলেন, গার্মেন্টসের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে এই ফাউন্ড্রি শিল্প। একই সঙ্গে এ শিল্প বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বগুড়ার কারখানাগুলোয় তৈরি টিউবওয়েলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে ব্যবহূত কৃষিযন্ত্রাংশের ৮০ ভাগের জোগানদাতা বগুড়া। শ্যালো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, যানবাহনের ছোট পার্টস, কল-কারখানার প্রয়োজনীয় পার্টসসহ কৃষির সব যন্ত্রাংশ তৈরি হয় এখানে। কৃষির জন্য পাওয়ার টিলারের লোহার চাকা, শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, মেশিনের যন্ত্র পিস্টন, গজল পিন, লাইনার হেডপিট তৈরি হচ্ছে। তবে কিছুদিন হলো কিছু গাড়ির ব্রেক ড্রাম তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়। তিনি বলেন, এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারি সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন সহজ শর্তে ঋণ। ফাউন্ড্রি মালিকরা জানান, ভারতের সাতটি রাজ্যে পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশি পণ্য। তবে বাংলাদেশের মোড়কে নয়, ওই দেশের কোম্পানির মোড়কে বিক্রি হচ্ছে। এতে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব আর দেশীয় পণ্য হারাচ্ছে স্বত্ব ও ব্র্যান্ড। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় যন্ত্রাংশ তৈরির ছোট একটি কারখানা গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকে। আজ সেই বগুড়া বাংলাদেশে কৃষিযন্ত্রাংশ তৈরির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি বিশেষ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই স্থানীয় উদ্যোক্তা ও স্বশিক্ষিত মেকানিকরা এখানে খুলেছেন সম্ভাবনার দুয়ার।

সর্বশেষ খবর