শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পায়রা ও পদ্মায় খুলছে উন্নয়নের দ্বার

দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের নতুন মাত্রা

রাহাত খান, বরিশাল

পায়রা ও পদ্মায় খুলছে উন্নয়নের দ্বার

প্রস্তুত হচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর - দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রবীণ রাজনীতিবিদ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি ৩০ ডিসেম্বর বরিশাল নগরীর সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলে বেসরকারি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, “আমরা কেউ চাইনি, এর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়েছেন। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু হচ্ছে। পদ্মা আর পায়রা নির্মাণ সম্পন্ন হলে দক্ষিণাঞ্চল হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা বাণিজ্যকেন্দ্র, দক্ষিণাঞ্চল হবে ‘সিঙ্গাপুর’।”

এর আগে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, পায়রা হবে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সমুদ্রবন্দর। সিঙ্গাপুর সমুদ্রবন্দরকেও ছাড়িয়ে যাবে পায়রা বন্দর। পায়রা বন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের ওপর চাপ কমবে। সময় সাশ্রয়ের কারণে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির জন্য পায়রা বন্দরের দিকে ঝুঁকবেন। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্ট, গোডাউন, শিপইয়ার্ড, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে উঠবে। এতে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। তখন লাখ লাখ শ্রমিক দরকার হবে দক্ষিণাঞ্চলে। এই শ্রমিক জোগান দেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেই। তাই এখন থেকেই শ্রমিক জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন তিনি।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের ভবিষ্যদ্বাণী গুরুত্ববহ বলে মনে করেন বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি ব্যবসায়ী মো. নিজাম উদ্দিন। তার মতে, আমদানি-রপ্তানিকারকদের দৃষ্টি এখন বরিশালে। পায়রা বন্দরের সুবিধা নিতে ইতিমধ্যে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে জমি কেনার হিড়িক পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের। বড় বড় শিল্পগ্রুপ বিশাল আয়তনের জমি কেনায় জমির দামও বেড়ে গেছে বহুগুণ। এতে সচ্ছলতা এসেছে হাজার হাজার পরিবারে।

২০২৩ সাল নাগাদ পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দর চালুর আগেই ব্যাপক শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্ট ও হাউজিং গড়ে উঠবে এখানে। একটি সমুদ্রবন্দর যে একটি অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দিতে পারে, সেটি দেখার জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে পায়রা সমুদ্রবন্দর চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন।

পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান কমডোর মো. সাইদুর রহমান জানান, একটি সমুদ্রবন্দর ঘিরে ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে।

পর্যটকরাও সেখানে আকৃষ্ট হন। সবকিছু মিলিয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবে বলে প্রত্যাশা তার। পায়রা বন্দরের সুবিধা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। পায়রা বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ হবে। সে লক্ষ্যে বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বন্দরে যাওয়ার চার লেনের কাজ চলছে। প্রকল্পের অন্যান্য কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। বন্দরের কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই এ অঞ্চলে পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পরিচালক ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, শিল্পমন্ত্রী দেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকেই পায়রা বন্দর ও পদ্মা সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনা দেখছেন। ব্যবসায়ী নেতা রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলেই বড়-ছোট অনেক শিল্পগ্রুপ বরিশালে তাদের কারখানা, গার্মেন্ট সম্প্রসারণ করবে। বরিশালে ব্যাপক শিল্প গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের শিল্পের কাঁচামাল পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে দ্রুত খালাস করা সম্ভব হবে। আবার ওই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য দ্রুত পায়রা বন্দর দিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা সহজ হবে। ভারতের সেভেন সিস্টারস এবং ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আমদানি-রপ্তানিকারকরা সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য চট্টগ্রাম এবং মোংলা সমুদ্রবন্দরকে পেছনে ফেলে পায়রা সমুদ্রবন্দরকেই বেছে নেবেন। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে বরিশালে শ্রমমূল্য কম থাকায় শিল্পোদ্যোক্তাদের পণ্য উৎপাদন খরচও কম পড়বে। এ কারণে পদ্মা সেতু আর পায়রা বন্দরের কাজ শেষ হলে বরিশালে শিল্প গড়ার প্রতিযোগিতা হবে বলে আশাবাদী ব্যবসায়ী রিন্টু। তবে অন্যান্য স্থানের শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বরিশালের শিল্পেও গ্যাস সংযোগ জরুরি উল্লেখ করে ব্যবসায়ী নেতা রিন্টু বলেন, যতক্ষণ না সরকার দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাসের সংযোগ দিতে না পারবে, ততক্ষণ এ অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানের (যেখানে গ্যাস আছে) চেয়ে তুলনামূলক কম সুদে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সম্প্রসারণে এসএমই ঋণের শর্তগুলো আরও সহজ ও সাধ্যের মধ্যে আনার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি। মন্ত্রীর মতো রিন্টুও স্বপ্ন দেখেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চল হবে ‘সিঙ্গাপুরের মতো’ শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনসমৃদ্ধ একটি উন্নত অঞ্চল, যাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী।

কৃষিতেও সমৃদ্ধ বরিশাল। দেশের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে এখনো বরিশালে ধানের উৎপাদন বেশি। বরিশালে উৎপাদিত ধান উত্তরবঙ্গে যায়। সেই ধান চাল হয়ে খাদ্যচাহিদা মেটায় দেশের বিভিন্ন স্থানের। এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারা-আমড়ার বাগান। এ ছাড়া নানা কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় ধান-নদী-খালের দেশ বরিশালে।

শুধু কি শিল্প-ব্যবসা আর কৃষি? শিক্ষায়ও ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বরিশালে। কারিগরি শিক্ষার জন্য এখানে রয়েছে পৃথক পুরুষ ও মহিলা টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (টিটিসি), টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিএসসি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সদর উপজেলার সাহেবের হাট এলাকায় বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং কীর্তনখোলা নদীর কর্ণকাঠী প্রান্তে মেরিন একাডেমি নির্মাণের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এখন শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষা। উচ্চশিক্ষার জন্য এখানে হয়েছে স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বরিশালে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় অর্ধশতাব্দী আগে। মেডিকেল কলেজটি এখন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার দাবি উঠেছে। পটুয়াখালীতেও মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তিন বছর আগে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, বরিশালে অনেকগুলো কলেজ সরকারিকরণ হয়েছে। নতুন সরকারি স্কুলও হয়েছে, হয়েছে বিশ্ববিদালয়। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও আছে। শিক্ষাবিস্তারের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে রাজনীতি মুক্ত রেখে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য বরিশালে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন।

যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও অনেক এগিয়েছে একসময়ের অনুন্নত দক্ষিণাঞ্চল। সরকারি-বেসরকারি দুটি বিমান সংস্থা যাত্রী পরিবহন করছে আকাশপথে। নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন এখনো দেশের যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে সুলভ ও সহজ। তবে নৌপথের উন্নয়ন এবং নদীর নাব্য রক্ষায় ধারাবাহিক ড্রেজিং দরকার বলে মনে করেন বরিশালের বিশিষ্ট জাহাজ ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস। বরিশাল থেকে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীতে বাকি থাকা পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা-পায়রা বন্দর মহাসড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করার লক্ষ্যে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মেগা প্রকল্প ‘পদ্মা সেতুর’ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ২০১৯ সালে এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ফরিদপুর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। কুয়াকাটায় পর্যটনশিল্পের উন্নয়নেও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বরিশালে পর্যটন করপোরেশনের ব্যানারে নির্মিত হচ্ছে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট পর্যটন মোটেল। বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় মাঝখানে দ্বীপসমৃদ্ধ বিশাল দুর্গাসাগর দিঘি, স্বরূপকাঠির আমড়া আর পেয়ারা বাগান এবং উজিরপুরের সাতলার শাপলার বিল ঘিরেও ব্যাপক পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক দৈনিক কীর্তনখোলার সম্পাদক সালেহ টিটু। কলাপাড়ার আন্দারমানিক নদীতীরে প্রায় ১২০০ একর জমিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং লেবুখালীর পায়রা নদীর তীরে বিশাল এলাকা নিয়ে সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর স্কুলছাত্রের চিঠির জবাবে মির্জাগঞ্জের পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পটুয়াখালীর বাউফলের বগায় লোহালিয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। পটুয়াখালীর দশমিনায় নির্মিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বীজবর্ধন খামার। উন্নয়নবঞ্চনার শিকার বরিশাল শেখ হাসিনার সুদৃষ্টির কারণে এখন আর উন্নয়নে পিছিয়ে নেই বলে মনে করেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম। সংগত কারণেই বরিশালে অপার ‘সম্ভাবনা’ রয়েছে বলে মনে করেন দলমতনির্বিশেষে সবাই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর