শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

জুয়েলারি দোকানের কার্ডে মেলে খুনির পরিচয়

মাহবুব মমতাজী

জুয়েলারি দোকানের কার্ডে মেলে খুনির পরিচয়

রাত তখন ১২টা। হোটেল কক্ষের তালা খুলে ভিতরে ঢোকে পুলিশ। সারা ঘরে লাশের গন্ধ। খাট ও দেয়ালের মাঝখানে ঝুলে আছে একটি নবজাতক। সেখান থেকে বের করার পর কয়েকটি আঙ্গুল নাড়াচ্ছিল নবজাতকটি। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। কম করে হলেও ১৮ ঘণ্টা যুদ্ধ করে শিশুটি বেঁচেছে। ওই ঘরেই পড়ে ছিল এক নারীর লাশ। কিন্তু নারীর লাশটি কার? কীভাবে তার মৃত্যু হলো? কে তার খুনি? কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিহতের আঙ্গুলের ছাপ নিয়েও ব্যর্থ হলো তারা। আর ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ওই নবজাতক। উপায় না পেয়ে ফের তল্লাশি শুরু করল ওই হোটেল কক্ষে। সেখানে একপর্যায়ে পাওয়া গেল একটি জুয়েলারি দোকানের কার্ড। সেই কার্ডের সূত্র থেকেই মেলে খুনির খোঁজ। ঘটনাটি গত বছর ২২ মের। রাজধানীর ফকিরাপুলের আবাসিক হোটেল আল শাহিনের একটি কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।

ওই হোটেল কক্ষে নারীর গলায় অনেকগুলো গিঁট দেওয়া ওড়না পেঁচানো ছিল। আর নবজাতকটি বিছানা ও দেয়ালের মাঝের ফাঁকা জায়গায় আটকে ছিল। হয়তো বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে সে। তাই দেয়াল ও খাটের ঘষায় গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে তার শরীরে। উদ্ধারকারী পুলিশ সদস্যরা প্রথমে ভেবেছিলেন যে শিশুটি মারা গেছে। কিন্তু নবজাতককে বের করার পর হাতের আঙ্গুলের নাড়াচাড়া দেখে বুঝতে পারেন সে বেঁচে আছে। এর পরই তারা তাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। গত বছর ১০ জুন চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার হন সন্দেহভাজন খুনি টিপু সুলতান (২৫)। জুয়েলারি দোকানের কার্ডের সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর ওই নারীকে শ্বাস রোধে হত্যার দায়ও স্বীকার করেন তিনি।

এই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) ইতিমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা আদালতে দাখিল করা হবে বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, জীবিত উদ্ধার হওয়া নবজাতকটিকে আদালতের মাধ্যমে লালন-পালনের জন্য তার মামার জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানায়, নিহত নারীর লাশ শনাক্ত করার মতো তেমন কোনো সূত্র ছিল না। তবে কক্ষে থাকা একটি ভ্যানিটি ব্যাগে চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী আসার বাসের টিকিট ছিল। কিন্তু যাত্রীর নাম নেই। আর আছে লক্ষ্মীপুরের রামগতির একটি জুয়েলারি দোকোনের কার্ড। একটি কাগজে লেখা ফোন নম্বর। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিঝিল থানার এসআই শেখ সাইফুল ইসলাম জুয়েলারির কার্ডটি নিয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতির সেই দোকানটি খুঁজে বের করেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। লাশের ছবি দেখালে দোকানি চেনেন না বলে জানান। এরপর পুলিশ লাশের ছবি দোকানিকে দিয়ে বলেন, এটা যেন সব ক্রেতাদের দেখানো হয়। এভাবে দেখাতে গিয়ে ৯ জুন এক নারী ছবিটি দেখে চিনে ফেলেন নিহত নারীকে। ওই নারী সেই খবর দেন নিহতের পরিবারকে। পরে নিহত নারীর পরিবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মেলে সব তথ্য-উপাত্ত। নিহত নারীর নাম রিনা আক্তার (২০)। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে। জীবিত উদ্ধার হওয়া নবজাতকটি তারই মেয়ে। গ্রেফতার টিপু এই শিশুটির বাবা। বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তিনি চট্টগ্রাম নগরে একটি দোকানে কাজ করেন। তার স্ত্রী রিনা চট্টগ্রামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। গোপনে পোশাককর্মী রিনাকে বিয়ে করেন টিপু। পরিবার সেই বিয়ে মেনে নেয়নি। তাই স্ত্রীকে হত্যা করে নবজাতককে রেখে পালিয়ে যান টিপু। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, গত বছর ২১ মে রাত প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে এই দম্পতি হোটেলে আসেন। তাদের কোলের নবজাতকটি তখন কাঁদছিল। হোটেলের খাতায় নামধাম না লিখে দ্রুত কক্ষে চলে চান। হোটেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কক্ষের চাবি দিয়ে দেন তাদের। পরদিনও যখন নাম-ঠিকানা লিখতে আসে না, তখন তাদের সন্দেহ হয়। কক্ষের বাইরে থেকে তালা লাগানো দেখে হোটেলের লোকজন ফেরত যান। কিন্তু দিন শেষে রাত হয়ে যাওয়ার পরও কেউ না আসায় সন্দেহ বাড়ে। পরে পুলিশকে খবর দিলে তারা গিয়ে তালা খোলার ব্যবস্থা করে। সূত্র জানায়, রিনার পরিবার খুবই দরিদ্র। তিন বছর আগে চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। সেখানে দোকানের কর্মচারী টিপুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর বছর দেড়েক আগে তাকে বিয়ে করেন। মাস তিনেক আগে অন্তঃসত্ত্বা রিনা স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি রামগতি যান। সেখানে তার সন্তানের জন্ম হয়। এরপর ১৭ মে রিনাকে সেখান থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যান টিপু। কিন্তু এর পর থেকেই রিনার সঙ্গে তার পরিবারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। গত বছর ৯ জুন পরিবারের লোকেরা জানতে পারেন রিনার খুন হওয়ার খবর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর