শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

ইতিহাসের নীরব সাক্ষী বাহাদুর শাহ পার্ক আজ মৃতপ্রায়

মোস্তফা কাজল

ইতিহাসের নীরব সাক্ষী বাহাদুর শাহ পার্ক আজ মৃতপ্রায়

পুরান ঢাকার মানুষ সকাল-বিকাল এখনো বাহাদুর শাহ পার্কে আসেন হাঁটতে। কেউ আবার হাতে সময় থাকলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেন। নাগরিক জীবনের শত রূঢ় বাস্তবতার ক্লান্তি ও অবসাদ কাটাতে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে বাহাদুর শাহ পার্কে আসেন অনেকে। যাওয়ার আর তেমন জায়গাও বাকি নেই এই কংক্রিটের জঞ্জালে ঘেরা রাজধানী শহরে। তাই পুরান ঢাকার মানুষের জন্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা এক চিলতে এই পার্কটি। এ পার্কের ইতিহাস বেশ পুরনো। উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক মেলা দিনের। আঠারো শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়াার্ড ক্লাব ছিল। স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছিল ‘আণ্ডাঘর’। দেখতে অনেকটা ডিমের মতোন বলে বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা ‘আণ্ডা’ বা ডিম নামে ডাকত। সেখান থেকেই এসেছে ‘আন্টাঘর’ কথাটি। ক্লাবঘরের সঙ্গেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এ ময়দানেই এ-সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এ স্থানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। ১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্কটি ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ নামেই পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’। পার্কটির আকার অনেকটা ডিমের মতোন গোল। চারদিক লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। পুব ও পশ্চিম পাশে দুটি গেট রয়েছে। পার্কটির ভিতরে রেলিংয়ের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা করা হয়েছে। এর চারপাশে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বেশকিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকার কারণে এটি পুরান ঢাকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পার্কের উত্তর পাশে রয়েছে সাধু থোমার চার্চ। এককালে এ চার্চ থেকে ভেসে আসত ঘণ্টাধ্বনি। পার্কে যারা ঘুরতে আসতেন তাদের কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠতেন সেই ঘণ্টার শব্দ শুনে। তার পাশেই ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহের জন্য তৈরি ট্যাংক। উত্তর-পূর্ব কোণে আছে ঢাকার অন্যতম পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও ইসলামিয়া হাই স্কুল। পুব পাশে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারি মুসলিম স্কুল, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। পার্কের ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশেই ঢাকার জজ কোর্ট। এ ছাড়া বাংলাবাজার, ইসলামপুর, শাঁখারীবাজারের মতো ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু স্থান রয়েছে এই পার্কটি ঘিরে। যদিও বতর্মানে বাহাদুর শাহ পার্কে স্বাস্থ্যসচেতন নগরবাসীর জন্য ঘুরতে আসাটাই এক দুষ্কর কাজ। কেননা পার্কটির চারপাশে গাড়ি পার্ক করে রাখা হচ্ছে। আশপাশেই রয়েছে ময়লা জড় করার বড় বড় কনটেইনার। এসব কনটেইনার ক্রমাগত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা পার্কটির পুব ও পশ্চিম পাশে দুটি প্রধান ফটক থাকলেও পশ্চিম পাশের ফটকটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। বন্ধ এই ফটকের সামনে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকান। সব মিলিয়ে পার্কটির বর্তমান অবস্থা বেশ করুণ। অথচ এ রকম ঐতিহ্যবাহী একটি স্থানের যথার্থ সংরক্ষণ খুবই দরকার ছিল। এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণে কখনই খুব একটা উদ্যোগী ছিল না কর্তৃপক্ষ। একরকম অবহেলার শিকার হয়েই পার্কটির বর্তমান এমন করুণ দশা। সঠিক পরিচর্যা না পেলে সামনের দিনগুলোয় হয়তো আর দেখতে পাওয়া যাবে না ইতিহাসের সাক্ষী বাহাদুর শাহ পার্কের অনেক চিহ্নই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর