রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রহস্যের জালে ১৫ খুন

একের পর এক বদল হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা, ক্লু মেলেনি কোনো

মাহবুব মমতাজী

রহস্যের জালে ১৫ খুন

প্রায় আড়াই বছর আগে রাজধানীর রামপুরায় মহানগর আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় খুন হন আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার। ঘটনাস্থলে তার হাত-পা বাঁধা লাশ পড়ে থাকে। ঘটনার এত দিনেও পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পরেনি হত্যারহস্য। শুধু ফাহমিদার ঘটনাই নয়, গত পাঁচ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া আলোচিত আরও ১৪ হত্যাকাণ্ড রহস্যের জালে আটকে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে কমপক্ষে আটটি বাসায় ১৫ জন খুন হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু এখনো এসব চাঞ্চল্যকর মামলার কার্যক্রম আটকে আছে তদন্ত সংস্থার কেস ফাইলেই। কোনো কোনো মামলায় একাধিকবার তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। এর পরও চিহ্নিত হয়নি খুনের মূল হোতারা।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, কোনোটিরই তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কিছু মামলায় আদালতে নারাজির পর তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে। আবার কিছু কিছু আসামি চিহ্নিত হলেও পাওয়া যায়নি যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ। তাই রহস্যের জট খুলতে এই দীর্ঘ সময়।

সেই ১৫ খুন : বাসার ভিতর খুনগুলোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম একটি ঘটনা হলো ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির খুন। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বাসায় ১২ বছরের স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবীকে শ্বাসরোধে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট দিনদুপুরে রামপুরার ওয়াপদা রোডের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি ফজলুল করিমকে। ২১ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার গোপীবাগে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় কথিত পীর লুত্ফর রহমান ফারুক ও তার ছেলেসহ ছয়জনকে। পরের বছর ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী। ২০১৫ সালের ১৩ মে পল্লবীতে নিজের ফ্ল্যাটে খুন হন গৃহবধূ সুইটি আক্তার ও তার মামা আমিনুল ইসলাম। একই বছরে বাসা থেকে উদ্ধার হয় আইনজীবী ফাহমিদা আক্তারের হাত-পা বাঁধা লাশ। ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর মগবাজারের মধুবাগে বাসার ভিতর থেকে ডলি রানী বণিক নামের এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনার মধ্যে গোপীবাগের ছয় খুনের মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অন্য নয়টি হত্যা মামলা থানা পুলিশ থেকে ডিবি হয়ে এখন তদন্তের দায়িত্ব গিয়েছে সিআইডিতে। এ বিষয়ে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ তোলা যাবে না। কারণ তদন্ত প্রভাবিত করতে অনেকে চাপ প্রয়োগ করে পুলিশের ওপর। তাই পুলিশের চেয়ে অন্য শক্তির দায় বেশি। পাঁচ বছর আগে হাজারীবাগের স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবী খুনের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঘটনাটির ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একজন আসামিকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সে এখন ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। সন্দেহভাজন ওই আসামি একসময় তাসনিমদের বাসায় সাবলেট থাকত। হয়তো তাকে গ্রেফতারের পর নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যাবে। গোপীবাগের ছয় খুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক কাজী গোলাম কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ঘটনায় গাফফার ও তরিকুল নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে রনি, আতিক, মাহফুজ ও জাহিদ নামে চারজনের তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের কোনো খোঁজ কিংবা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এসব পেলে তদন্তে ভালো কিছু একটা অর্জন হতো। জানা গেছে, ওই মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে এখন পর্যন্ত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ছয় সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। মাওলানা ফারুকী খুনের তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পরিদর্শক আরশাদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত ওই মামলায় বিভিন্ন সংস্থা আটজনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে দুজন জামিনে বাইরে। অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার মূল হোতা কে— সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই। তবে নেপথ্যে জঙ্গিসম্পৃক্ততা, সম্পত্তিগত, অর্থনৈতিক বা পারিবারিক নানা বিষয় ঘিরে তদন্ত অব্যাহত আছে। এদিকে ফাহমিদা হত্যার প্রায় আড়াই বছর পরে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আলী আজম। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, খুনি শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ফাহমিদার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এমন চারজনকে তার সন্দেহ। শুধু তথ্য-প্রমাণের অপেক্ষা। সেগুলো হাতে এলেই আসামিদের গ্রেফতার করবেন। জানা যায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সিআইডির সাবেক এএসপি ফজলুল করিমকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে মুখোশধারী তিন অস্ত্রধারী। আজও খুনিদের মুখোশ উন্মোচন হয়নি। পুলিশ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দিলেও তাতে আস্থা রাখতে পারেনি নিহতের পরিবার। তাই নতুন করে মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। পল্লবীতে ফ্ল্যাটে জোড়া খুনের ঘটনায়ও দীর্ঘ সময় ধরে অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপ-পরিদর্শক মোফাজ্জল হোসেন জানিয়েছিলেন, সুইটির স্বামীকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ হলেও ঘটনায় সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওই ঘটনার অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। মগবাজারের বাসায় গৃহবধূ ডলি রানী বণিকের হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রতনকৃষ্ণ নাথ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিহতের শ্বশুর-শাশুড়িকে আসামি করে ডিবি পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। স্বজনরা নারাজি দিলে শুরু হয় নতুন তদন্ত। এখনো তার শ্বশুর-শাশুড়িকে সন্দেহ করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে পুলিশের মধ্যে একধরনের রাজনৈতিকীকরণ হয়। তাদের ওপর রাজনীতিবিদসহ নানা পক্ষ বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যে কারণে হয়তো তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর