শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ওয়ালিউর রহমান

বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে কোন ভাষা বংশ হতে এই ভাষাটির উৎপত্তি।

ঐতিহাসিক ভাষাবিদের মতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশ হতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলাদেশের আদিবাসীরা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বাঙালি জাতি হলো একটি সঙ্কর বা মিশ্র জাতি ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির মতোই বাংলা ভাষাও একটি সঙ্কর বা মিশ্র ভাষা। অনেক ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞানী বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের মূল্যবান মতামত দিয়েছেন এবং তারা তাদের পক্ষে জোরালো যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। তার মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যতম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল। আনুমানিক আড়াই হাজার বছর খ্রিস্টপূর্বাব্দে মূল ভাষা থেকে যেসব প্রাচীন ভাষার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্য ভাষা, আর্য ভাষার তিনটি শাখা আছে। এগুলো হলো ইরানীয়, দারদীয় ও ভারতীয়। এ থেকেই ভারতীয় আর্য ভাষার সৃষ্টি। কালের বিবর্তন ও বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় আর্য ভাষাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। যেমন : ১। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা ২। মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা ৩। নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা। ভারতীয় আর্য ভাষার এই তিনটি স্তরের মধ্যে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে গৌড়ী প্রাকৃতের পরিণত অবস্থা গৌড়ী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। বস্তুত, মাতৃভাষাই একজন মানুষের পরিচয়ের শ্রেষ্ঠতম উৎস। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশেষ কোনো মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে। যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত, সে জাতি সব দিক থেকেই তত উন্নত—এমন ধারণা সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীতে অনন্য ভাষার চেয়ে গৌরবের এই জন্য যে, তা একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। এ সূত্রে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিকদের। বস্তুত, তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের ফলেই যেমন রক্ষা পেয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালি সত্তায় মিশে আছে। এটি বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মানুসন্ধানের প্রধান প্রতীক। একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। এটিই আমাদের অহঙ্কার। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরা লিওন। সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেই ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ বাংলাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।

বর্তমানে ভাষাশক্তি সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে পাকিস্তান, ভাষাশক্তির বৈশ্বিক সূচকে তারা বাংলাদেশের চেয়ে এখন ১৫ ধাপ পেছনে। ফ্রান্সভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইনসিয়েড’-এর সম্মানিত ফেলো ড. কাই এল চানের তৈরি ‘পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইনডেক্স-পিএলআই-২০১৬’ এমনই তথ্য দিচ্ছে। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় এনে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৩০তম।

বিশ্বে প্রচলিত ছয় হাজার থেকে আট হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা সমমর্যাদায় আপন স্থান অধিকার করে আছে। বাঙালি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলা ভাষার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। এই অনুমান পরিসংখ্যানবিদদের। প্রচলিত ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলার স্থান চতুর্থ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসআইএল ইন্টারন্যাশনালের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি ‘ইথনোলগ’-এর প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে উইকিপিডিয়ার ২০১৭ সংস্করণে বলা হয়েছে, ভাষাভাষীর বিবেচনায় বিশ্বে বাংলা ভাষা অষ্টম। তবে মূল ভাষা হিসেবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলার অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। ২৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাকে মূল (প্রথম) ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১১ সালের হিসাবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখ। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহূত প্রধান ভাষা বাংলা। বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কাছার জেলায় প্রচুরসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। কাছার জেলারও অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দর বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন বাংলা ভাষাটাকে অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। তাই যে করেই হোক দেশজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা করে বিদেশি অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। আমাদের দেশপ্রেম, সজাতিপ্রীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সর্বোপরি, ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়ন, সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা ভাষার দূষণ রোধ করতে সরকারকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। বাঙালি, বাংলা ভাষা, একুশের চেতনা, একাত্তরের স্বাধীনতা, দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সার্বভৌমত্ব এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রকেই নজরদারি করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত

সর্বশেষ খবর