শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাড়ছে বইয়ের বোঝা কমছে খেলার মাঠ

শিক্ষার হালচাল - ৭

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সকাল ৬টায় ঘুমের রেশ না কাটতেই স্কুলে পৌঁছাতে হয় ছোট্ট নুসরাতকে। বয়স চার বছর পার হতেই মা-বাবা রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিশুশ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়েছেন তাকে। এখনই তাকে পড়তে হয় বাংলা, ইংবেজি, গণিতসহ মোট পাঁচটি বিষয়। ছয়তলা ভবনের দুটি ফ্লোরে চলে স্কুলের কার্যক্রম। কোনো খেলার মাঠ না থাকায় স্কুল শেষে নুসরাতের সময় কাটে টেলিভিশন আর ভিডিও গেমসের পর্দায় চোখ রেখে।

রাজধানীর অলিগলিতে গড়ে ওঠা স্কুল এবং বাসাবাড়ির পাশে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা ও খেলার মাঠ না থাকায় ফ্ল্যাটবন্দী হয়ে পড়ছে শিশুরা। বিনোদনহীন পড়াশোনায় শিশুদের শিক্ষাজীবন হয়ে পড়ছে একঘেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা জরুরি। খেলার মাঠে শিশুরা বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, সৌজন্য, টিমওয়ার্ক শেখে। অতিমাত্রায় টেলিভিশনে আসক্তি শিশুদের মননে ঢুকিয়ে দেয় বিকৃত আকাশ-সংস্কৃতির উপাদান।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের ওপর বই আর পড়ার চাপ ক্রমেই বাড়ছে। অভিভাবকরাও ছুটছেন ভালো রেজাল্টের দিকে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষার স্তর একটি হলেও কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে নার্সারি, প্লে, কেজি ওয়ান, কেজি টুসহ তিন থেকে চার বছর ধরে পড়ানো হয় শিশুদের। আবার এ সময় শিশুদের খেলাধুলার মধ্যদিয়ে মাতৃভাষা, অক্ষর ও সংখ্যার ধারণা দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের ব্যাকরণ এমনকি বিজ্ঞানও পড়ানো হয়। পাঠ্যবই থাকে ৬-১২টি পর্যন্ত। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্যবই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ৩টি। এ ছাড়া তৃতীয়          থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই নির্ধারিত আছে ৬টি করে। সরকারি স্কুলগুলো এ কারিকুলাম অনুসরণ করলেও বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে কারিকুলামের বাইরে ৭ থেকে ৮টি করে অতিরিক্ত বই। সাম্প্রতিককালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার কারণে হঠাৎ করেই পঞ্চম শ্রেণিতে চাপ বেড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। ২০১৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বিষয়ে বেসরকারি সংগঠন গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পিইসি পরীক্ষার কারণে স্কুল, প্রাইভেট টিউশনির বাইরে শুধু বাধ্যতামূলক স্কুল কোচিংয়ে বছরে শিক্ষার্থীদের ব্যয় হয় ৪১২ ঘণ্টা। এসব পরীক্ষায় সবকিছু ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে ভালো ফল। এ ছাড়া অন্যান্য শ্রেণিতেও রয়েছে ক্লাস টেস্টসহ নানা পরীক্ষার চাপ। এদিকে ক্রমান্বয়ে বইয়ের বোঝা বাড়লেও খেলাধুলার জায়গা কমছে শিশুদের। পাহাড়সম দালান-কোঠার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশবের খেলার মাঠ। সরেজমিন লালমাটিয়া নিউ কলোনি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। মাঠটি খেলার জন্য হলেও খেলার কোনো পরিবেশই নেই। ধুলোময় মাঠে ঘাসের কোনো অস্তিত্ব নেই। মাঠের এক পাশ দখল হয়ে আছে সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী দিয়ে। অন্য দুই পাশ ময়লার স্তূপ ও নানা ধরনের খাবার এবং চায়ের দোকানে বেদখল হয়ে রয়েছে। এরকম অধিকাংশ খেলার মাঠ দখল করে চলছে নানা রকম উৎসব, কনসার্ট অথবা মাদকের আসর। প্রভাবশালীদের দখলে সংকুচিত হয়ে আসছে মাঠের জায়গা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় ৩৮টি খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে ৭টি। মাঠগুলো সংস্কারে প্রতিবছরই কাজ করছি আমরা।  ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, দক্ষিণ সিটির আওতায় ৯টি খেলার মাঠ রয়েছে। এই মাঠের পাশাপাশি ১৯টি খেলার মাঠ সংস্কারে মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শিশুদের জন্য বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার শিক্ষা শিশুরা খেলার মাঠ থেকে পায়। অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ঘাত-প্রতিঘাত মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় তারা। আর এ জন্য শিশুকাল থেকেই হতাশা, বিষণ্নতা, সামাজিক দক্ষতার অভাব এবং ব্যক্তিত্বহীনতা দেখা দেয় ফ্ল্যাটবন্দী শিশুদের মধ্যে।

সর্বশেষ খবর