বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে আসছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট

বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ছয় গুণ

রুহুল আমিন রাসেল

আগামী ৪ মার্চ তিন দিনের ঢাকা সফরে আসছেন চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের পাশে থাকা আরেক বন্ধুরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি ত্রান দাই কুয়াং। প্রগতিশীল এই দেশটিতে ৩৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ছয় গুণেরও বেশি বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে এ দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের অন্যতম প্রতিযোগীও বাংলাদেশের পরে স্বাধীন হওয়া ভিয়েতনাম। বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারে ২০১২ সালে চুক্তি হওয়ার পরও দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যকার যোগাযোগের অভাবে আন্তবাণিজ্য বাড়ছে না বলে জানা গেছে।

সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৬ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য ভিয়েতনামে রপ্তানি করে। এর বিপরীতে ভিয়েতনাম থেকে ৪১২ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩৪৫ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার। যদিও ১০ বছর আগে ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল না। তবে বাণিজ্য ছিল খুবই কম। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ভিয়েতনামে প্রায় ১৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বাংলাদেশ আমদানি করে মাত্র ১১ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে কৃষিজাত, চামড়াজাত ও প্রকৌশল পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, ওষুধ, খেলনা, ফার্নিচার, বিশেষায়িত বস্ত্র, নিট ও ওভেন পোশাক এবং প্লাস্টিক সামগ্রী। আর ভিয়েতনাম থেকে মূলত খনিজ দ্রব্য, চাল, বস্ত্র ও বস্ত্রসামগ্রী, যন্ত্রপাতি ও প্লাস্টিক উপাদান, কৃষিপণ্য, পাল্প, পেপার ও পেপারবোর্ড এবং এয়ারক্রাফট আমদানি করে বাংলাদেশ।

এমন প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতির ঢাকা সফরে ‘বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম বিজনেস ফোরাম’ আয়োজন করা হচ্ছে। এতে ভিয়েতনামের ২০০ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নেবে। এই ফোরামে খাতভিত্তিক সম্ভাবনা চিহ্নিত করে তাতে বিনিয়োগ ও যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এ দেশে আকর্ষণীয় বিনিয়োগের জন্য কর অবকাশ ও করপোরেট কর সুবিধা রয়েছে। এই সুবিধা ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সিরামিক, হালকা প্রকৌশল শিল্প ইত্যাদি খাতে যৌথ বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ালে উভয় দেশের অর্থনীতিই লাভবান হবে। অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা বিদেশিদের জন্য সহজ ও লাভজনক। তবে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের চেয়ে অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিয়ে ভিয়েতনাম রপ্তানি করে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৩৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। কম মানুষ দিয়ে কীভাবে বেশি উৎপাদন করতে হয়, তা ভিয়েতনামের কাছ থেকে শেখার আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর থেকে শুরু করে চাল আমদানি এসব বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাই। কৃষি খাতে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা ও তাদের বিনিয়োগ কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। গতকাল তিনি টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম প্রতিদ্বন্দ্বী। তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগী হলেও বাংলাদেশের নিচে অবস্থান করছে ভিয়েতনাম। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্যে ভিয়েতনাম আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের সঙ্গে রপ্তানির হিসাব করলে চলবে না, বরং ব্যবসা বাড়াতে হবে। কারণ ভিয়েতনাম আমাদের দুর্দিনে চাল রপ্তানি করে।’ ভিয়েতনামের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যাং ডিন কুই গত সপ্তাহে ঢাকা সফরে এসে বলেন, চলতি বছরে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ব্যবসা ২৫ শতাংশ বাড়বে। অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থকেই গুরুত্ব দেবে ভিয়েতনাম। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের বাইরে দুই দেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চায় ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আরও জোরদার করা যেতে পারে। এটি দুই দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে আরও নিবিড় যোগাযোগ এবং ফলপ্রসূ আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের তুলনামূলক অর্থনৈতিক চিত্র : ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন হয় ৩ লাখ ৩১ হাজার ২১০ বর্গ কিলোমিটারের ভিয়েতনাম। অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেখানে ১৬ কোটি ১৭ লাখ সেখানে ভিয়েতনামের রয়েছে ৯ কোটি ৫২ লাখ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ২৪৫ বিলিয়ন ডলার হলেও ভিয়েতনামের ২১৫ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির হিসাবেও এগিয়ে বাংলাদেশ। ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে জনপ্রতি বার্ষিক গড় আয়ে এগিয়ে ভিয়েতনাম। দেশটির জনপ্রতি বার্ষিক গড় ১ হাজার ৯৯০ ডলার হলেও বাংলাদেশের ১ হাজার ৬১০ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দুই দেশ কাছাকাছি অবস্থান করলেও আমদানি-রপ্তানিতে ফারাক আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশ যেখানে বিশ্ববাজারে মাত্র ৩৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, সেখানে ভিয়েতনাম করছে ১৬৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ যেখানে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, সেখানে ভিয়েতনাম করে ১৬১ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বাণিজ্যে দুই দেশই চীনের ওপর বেশি নির্ভরশীল।

সর্বশেষ খবর