শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আনসারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি দখলের অভিযোগ

তাঁবু বসিয়ে ১০ জায়গায় পাহারা হুমকি দেওয়া হচ্ছে মালিকদের মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আনসারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জমি দখলের অভিযোগ

জনগণের জমি দখল করে আনসারের ক্যাম্প —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারি আনসার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজধানীর ভাটারার ছোলমাইদ এলাকায় সাধারণ মানুষের জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভাটারা এলাকায় অন্তত ১০টি জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মূল্যবান জমি দখলে নিয়েছে মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার বাহিনী। এ নিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ    ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে ভুক্তভোগী বিক্ষুব্ধ জনগণ সংশ্লিষ্ট থানা ও আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, দখলদার আনসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে আরও যাদের জমি রয়েছে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে আনসারদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একটি বেসরকারি আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে তারা এসব জমি কিনেছেন। কিন্তু জমি কেনার পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারছেন না সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। এমনকি যে আবাসন কোম্পানির কথা বলা হচ্ছে তাদের এক ইঞ্চি জমিও ওই এলাকায় নেই বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সরকারি একটি বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সংস্থার নামে জমি কেনার কোনো সুযোগ নেই। গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে ‘আনসার বাহিনীর ক্রয়কৃত সম্পত্তি’- লিখে বেশকিছু স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আবার তাঁবু খাটিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছেন আনসার বাহিনীর সদস্যরা। রহস্যজনভাবে বসানো এসব তাঁবু ও টিনের বেড়া দেখে যে কেউ বুঝবে তা দু-একদিন আগে বসানো হয়েছে। এসব তাঁবুতে থাকা আনসার সদস্যদের অনেকটাই সতর্ক অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। তিন-চারজন করে আনসার দিয়ে একেকটি প্লট দখল করা হয়েছে। কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আনসার সদস্যের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলেও তাদের কারও পোশাকে নেমপ্লেট নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, আনসারদের দখল করা এসব প্লট তাদের নিজেদের জমি। সেই জমির বৈধ কাগজপত্রও তাদের রয়েছে। এসব জমির নামজারি, আরএস ও এসএ পর্চার কপিও রয়েছে তাদের কাছে। এসব কাগজপত্র দেখিয়ে তারা বলেছেন, আমাদের বৈধ জায়গা-জমি আনসাররা গায়ের জোরে দখল করেছে।

ভাটারা এলাকার আতিকুল ইসলাম গতকাল ১২টার দিকে নিজের জমি দেখিয়ে বলেন, ‘সিএস ১৬১০ ও ১৬১২ দাগের জমিটি আমার নিজস্ব সম্পত্তি। কিন্তু এখানে গত এক বছর ধরে আনসার সদস্যরা নিজেদের ক্রয়কৃত জমি বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন। আমার জমির দলিল দস্তাবেজ নিয়ে আনসারদের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো লাভ হয় না। আর তাদের জমি কেনার পক্ষে কোনো কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তাও দেখাতে পারছেন না। সরকারি বাহিনী হয়ে এমন কাজ মেনে নেওয়া যায় না।’ সিএস ১৬০৫ দাগটির জমির মালিক গোলাম মোস্তাফা ঢালী। তার এ প্লটে গিয়ে দেখা যায়, আনসারের সাইনবোর্ড ঝুলানো। সেখানে ৬ কাঠা জমি আনসার ক্রয় করেছে বলে দাবি করছে। কিন্তু গতকাল দুপুরে গোলাম মোস্তাফা ঢালী তার কাগজপত্র দেখিয়ে বলেন, ‘আমার জমিটি রাতের আঁধারে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখলে নিল আনসার সদস্যরা। এখন এখানে আসতে চাইলে অস্ত্রের ভয় দেখানো হয়। নিজের সম্পত্তি এখন চোখে সামনে অন্যরা নিয়ে যাবে তা মেনে নিতে পারছি না। আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের কাছে বিচার চাই।’ স্থানীয় বাসিন্দা হাজী আলী আকবর বলেন, ‘আমার ৫ কাঠা জমি প্রথমে বসুমতী আবাসিক প্রকল্পের লোকজন দখল করেছে। এখন সেই জমি হাতবদল করে আনসার দখলে নিয়েছে। অথচ এ জমির জন্য আমি ২০১৭ সাল পর্যন্ত খাজনার টাকাও পরিশোধ করেছি। জমি ফিরে পেতে চাইলে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। আনসারদের অস্ত্রের সামনে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে জনগণকেই ভয় দেখানো হচ্ছে। আমরা এ অবিচার থেকে মুক্তি চাই।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত ৯ ফেব্রুয়ারি হীরাঝিল বসুমতী আবাসিক প্রকল্পের মালিক ভণ্ড পীর নাসির উদ্দিন নাসুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন স্থানীয়রা। জমি হারানো বাসিন্দারা তাদের সেই সম্পদটুকু ফিরে পেতে আন্দোলনে নামেন। কিন্তু নাসুর লেলিয়ে দেওয়া মাস্তান ও আনসার বাহিনীর হাত থেকে নিস্তার মিলছে না তাদের। এরপর এলাকাবাসী মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। ‘ভাটারা মৌজার ছোলমাইদ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত জমি রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে বসুমতী আবাসিক প্রকল্পের সামনে শান্তিপূর্ণ এই মানববন্ধনে অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। গ্রামবাসী বলেন, তাদের পৈতৃক সম্পত্তি জোর করে দখলে নিয়েছে হীরাঝিল বসুমতী আবাসিক প্রকল্প। দখলে নেওয়া এসব জমি ফেরত পেতে তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ মানববন্ধনের পরপরই নাসুর ইশারায় জমিতে সাইনবোর্ড টানানো শুরু করে আনসার সদস্যরা। তারা কমপক্ষে ১০টি জায়গায় সাইনবোর্ড ও তাঁবু টানিয়ে জমি দখল করেছে।

ভাটারা মৌজার ছোলমাইদ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত জমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আলহাজ নজরুল ইসলাম ঢালীর নেতৃত্বে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সিদ্দিকুর রহমান ঢালী, আতাউর রহমান ঢালী, হাজী মোশারফ হোসেন খন্দকার, দেলোয়ার হোসেন, মো. সিরাজ, মো. আতাউর রহমান মাতবর, মো. রুহুল আমীন, মো. আসাদুজ্জামান, মো. দিলু খন্দকার ও গোলাম মোস্তফা। আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম ঢালী, মো. সিরাজ ঢালী, আনোয়ার হোসেন, মোক্তার হোসেন, আশবুর রহমান, মো. মিলন, মো. ফারুক, মো. মাসুম, মাহাবুবুর রহমান ও রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়াও জমি হারানো কয়েকশ ভুক্তভোগী তাদের জমির মূল কাগজ ও দলিলাদি নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, হীরাঝিল বসুমতী আবাসিক প্রকল্পের নামে ভণ্ড পীর নাসির উদ্দিন নাসু শতাধিক বিঘা জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে। এই প্রকল্পে নাসুর এক শতাংশ জমিও নেই। এখন জবরদখল করা জমিতে নাসু স্থাপন করেছে আনসার ক্যাম্প। ওই প্রকল্পের আদি জমির মালিকরা ঢুকতে চাইলেও আনসার ও নাসুর ভাড়াটিয়া মাস্তানদের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। ওই নির্যাতনের হাত থেকে নারী, পুরুষ এমনকি বৃদ্ধ মানুষও রেহাই পাচ্ছেন না।

এরই মধ্যে স্থানীয় ছোলমাইদ এলাকার বাসিন্দা মো. ফারুক হোসেন বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আনসার সদস্যদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলার আর্জিতে অভিযোগ করা হয়েছে, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ও গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাদীর ক্রয়কৃত সম্পত্তিতে গিয়ে আসামিরা তার ভাড়াটিয়াকে জমির দখল ছেড়ে দিতে হুমকি দেয়। সেই সঙ্গে বাদীকে পাওয়া মাত্র ক্ষতি করার হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি ইতিমধ্যে স্থানীয় ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এ ছাড়া এসব দখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দা মো. সিরাজ গত ১৫ তারিখে একটি জিডি করেছেন। একই দিনে আতিকুর রহমান নামের আরেকজন প্লট মালিকও থানায় জিডি করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা পেতে এর আগেও একাধিক জিডি করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আনসারের কমান্ডার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা এখানে কারও জমি দখল করতে বা কারও জমি রক্ষা করতে আসিনি। আনসার একটি বিশেষায়িত বাহিনী। হলি আর্টিজানে হামলার পর এখান থেকে আমরা আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছি। সম্প্রতি বসুমতী ও আশপাশ এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে মোট ৪৩ কাঠা জমি ক্রয় করা হয়েছে। এ জমিতে আনসারের জন্য আবাসন ও অফিস করা হবে। জমিটি আনসারের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ক্রয় করা হয়েছে। এখানে আনসারের ২০০ সদস্য বর্তমানে রয়েছেন।’ আনসার এভাবে খণ্ড খণ্ড জমি ক্রয় করে কী করবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে এসব জমি ক্রয় করেছি। এসব জমি সংস্থার বিভিন্ন কাজে লাগানো হবে।’ আনসার সদস্যদের নেমপ্লেট নেই কেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় অপারেশন মুডে থাকি বলেই নেমপ্লেট লাগানো হয় না।’

সর্বশেষ খবর