সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি, পালিয়ে এলো আরও রোহিঙ্গা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি, পালিয়ে এলো আরও রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে দিন দিন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পর ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল পর্যন্ত তা হয়নি। উল্টো প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত রয়েছে। দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত যাবে। প্রতিদিন ৩০০ করে দুই বছরে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের গ্রহণের জন্য মিয়ানমারে দুটি ‘ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা করা হবে এমন একটি সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় দুই মাসের মাথায় মিয়ানমার সরকার ক্যাম্প স্থাপনের পরিবর্তে বাংলাদেশ সীমান্তে বাঙ্কার স্থাপন ও সেনা মোতায়েন জোরদার করে নতুন করে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তা বাড়ছে। কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের শরণার্থী-সংক্রান্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, ‘এখনো অনেক কাজ বাকি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে আরও সময় লাগবে। ভেরিফিকেশন ও ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপনের কাজও বাকি রয়েছে।’

 এদিকে শুক্রবার ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক এবং প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের কোনো মন্ত্রী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলেও প্রত্যাবাসন বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগামিতা নেই বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-সংশ্লিষ্টরা। দফায় দফায় বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়গুলো মিয়ানমারের কূটনৈতিক চাতুর্য বলে মনে করছেন তারা। এটি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনেরও একটি কৌশল বলে মনে করছেন শরণার্থী বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ শুক্রবার অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য দেওয়া এ তালিকার প্রতিও অনীহা দেখিয়ে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়াও সুইকফি বলেছেন, ‘যাচাই-বাছাই করে তাদের নাগরিক হলে ফেরত নেওয়া হবে।’

এদিকে শনিবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ হয়ে এক দিনেই ২৮৩ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। একইভাবে গতকাল মাছ ধরার নৌকায় করে আরও সাতটি রোহিঙ্গা পরিবার এপারে চলে এসেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি উত্তর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাসদস্য বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বাঙ্কার নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। গতকালও নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও জলপাইতলী সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের টহল লক্ষ্য করা গেছে বলে জানা যায়। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দিন দিন অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিদোয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশ একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল, সদ্য আগত রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও বহুল প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হয়নি। ফলে প্রত্যাবাসন নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও তা কোনো ফল বয়ে আনেনি বলে মনে করছেন দেশের সচেতন মহল।

শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্পষ্টতই কয়েকটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। তা হচ্ছে—রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে, রোহিঙ্গারা সেখানে কতটুকু নিরাপদ, রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবে কি না, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের জীবন-জীবিকার কী হবে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক ও পরবর্তীকালে ‘বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের প্রত্যাবাসন’ সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে নাগরিকত্বের বিষয়টি আদৌ নেই। মিয়ানমার এদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। রোহিঙ্গা নামেও আপত্তি রয়েছে তাদের। এমনকি কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। মিয়ানমার এদের ‘বাঙালি’ হিসেবে স্বীকার করে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় এবং ডকুমেন্টে কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি নেই। এ বিষয়গুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর