বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

জীবিকা আর শিক্ষার প্রয়োজনে বাংলা

জিন্নাতুন নূর, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরে

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যোগাযোগের জন্য নিজ ভাষার ব্যবহারেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। দেশ স্বাধীনের পরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বল্পসংখ্যক মানুষ ছাড়া অধিকাংশই নিজ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে অস্বস্তিতে ভুগতেন। তবে সময় বদলেছে। দুর্গম পাহাড়ের কোলে, প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী এসব মানুষের অন্য ভাষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। নিজেদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনবোধ এবং আদি পেশা থেকে সরে উন্নত জীবনযাপনের আশায় এই জনগোষ্ঠী এখন বাংলা রপ্ত করছে। বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের যেমন বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় ঘটছে অন্যদিকে পাহাড়ি, অবাঙালি বিভিন্ন বয়সী মানুষও জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। এমনকি তারা স্থানীয়ভাবে যেসব পত্রপত্রিকা প্রকাশ করছেন তাও প্রকাশিত হচ্ছে বাংলায়। সরেজমিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় পাহাড়ি জনবসতির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিশুদের বাংলায় শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। মাধ্যমিকেও সমানতালে চলছে বাংলায় পাঠদান। কথা হলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েকজন অভিভাবক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় সন্তানদের তারা বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন। এখানে তাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তাদের নিজ ভাষায় শিক্ষা পদ্ধতি ও পাঠদানব্যবস্থা ভালো হলেও বাংলাকেও তারা স্বাগত জানাচ্ছেন। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির সাজেকে অবাঙালি হোটেল ব্যবসায়ী ও রিসোর্ট পরিচালনাকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষজনও এখন স্বচ্ছন্দে বাংলা বলছেন।

সাজেকে এক অবাঙালি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্ম এখন নিজ ভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন থাকায় বাংলায়ও কথা বলছে। কিন্তু তিনি মনে করেন, ত্রিপুরা ভাষার সংক্ষরণেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ত্রিপুরা ভাষা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়বে। রাঙামাটির বড়দাম এলাকায় ব্রিজের পাশে অবস্থিত বাজারে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বয়স্করা বাংলা বুঝলেও বাংলায় তেমন কথা বলেন না। তরুণ প্রজন্ম ও শিশু-কিশোররা বাংলা বোঝে এবং বাংলায় কথাও বলে। বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, এখানে এখন প্রচুর বাঙালি পর্যটক ঘুরতে আসেন। এ ছাড়া ব্যবসার প্রয়োজনে তাদের প্রায়ই রাঙামাটি শহরে যেতে হয়। সেখানে অন্য বাঙালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের বাংলায় কথা বলতে হয়। অর্থাৎ ব্যবসার প্রয়োজনেই তাদের বাংলা শিখতে হচ্ছে। এই বাজার থেকে সামনে কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পর্যটকদের জন্য একটি লেক শোর ক্যাফে খোলা হয়েছে। যেখানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের নৌকা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ‘ডিসকভারি ট্যুরস’-এর প্রধান পরিকল্পনাবিদ ও ভ্রমণ ব্যবস্থাপক রিটন চাকমা জানান, দুর্গম পাহাড় ঘিরে এখন যে পর্যটন কেন্দ্র ও রিসোর্টগুলো তৈরি করা হয়েছে সেখানে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর তরুণরা বিনিয়োগ করছেন। আর এখানে যে কর্মচারীরা কাজ করছেন অবাঙালি হলেও ভালো বাংলা বলেন ও বোঝেন। এমনকি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের খবরাখবর পৌঁছে দিতে এখন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন দৈনিক ও মাসিক পত্রপত্রিকা প্রকাশ করছেন। রাঙামাটির বড়দাম বাজারে একজন অবাঙালি পত্রিকা হকার জানান, পাহাড়ি জনগণের অনেক খবর আছে যেগুলো সাধারণ বাঙালিদের কাছে পৌঁছায় না। আর দেশের মানুষের কাছে সেই তথ্য পৌঁছে দিতে তারা বাংলায় পত্রিকা প্রকাশ করছেন।

সর্বশেষ খবর