বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

লিয়াজোঁতে চলছে শিশু-শিক্ষা

শিক্ষার হালচাল ২১

জয়শ্রী ভাদুড়ী

শিশু বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হয় শিশুশ্রেণিতে। এ সময় গড়ে ওঠে তার ভবিষ্যতের ভিত্তি। স্কুলের শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় শিশুশ্রেণিতে ভর্তির মধ্য দিয়ে। অথচ কোনো ধরনের সিলেবাস বা সরকারি তত্ত্বাবধান ছাড়াই চলছে শিশুশ্রেণির পাঠদান। প্রতিষ্ঠানগুলো যে যার পছন্দ অনুযায়ী নির্ধারণ করছে লেখক আর বইয়ের সংখ্যা।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার চাইল্ড কেয়ার সেন্টার নামে একটি কিন্ডারগার্টেনে শিশুশ্রেণিতে ‘ভর্তি চলছে’ বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকরা এককালীন ভর্তি ফি, সেশন চার্জ, ত্রৈমাসিক পরীক্ষার ফি দিয়ে মোট দুই হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে শিশুকে ভর্তি করিয়েছেন। ভর্তি শেষে শিশুদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আটটি বইয়ের তালিকা সংবলিত বুকলিস্ট। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণজ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি, ধর্ম, ইংরেজি শব্দের বই এবং বাংলা ব্যাকরণ। শিশুদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদানের বিষয়ে বলা হলেও এই স্কুলগুলো বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে শিশুদের কাঁধে। আর এই বইগুলোতে রয়েছে অসংখ্য বানান এবং তথ্যগত ভুল। বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন কমিশন নিয়ে লিয়াজোঁ করে চাপিয়ে দিচ্ছে পছন্দসই লেখকের বই। লেখকের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রেখে অথবা কমিশন ভেদে লিয়াজোঁ করে বাধ্যতামূলক বইগুলো কেনানো হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। কোনো নির্ধারিত বই না থাকায় এসব ভুলেভরা বই পড়তে হচ্ছে শিশুদের। সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ নেই কিন্ডারগার্টেনের শিশুশ্রেণির ভর্তির তত্ত্বাবধানে। অনিবন্ধিত  এসব স্কুলের শিশুশ্রেণির অবস্থা সবচেয়ে হতাশাজনক। নিজেদের ইচ্ছামতো তথ্য প্রবেশ করানো হচ্ছে শিশুর মননে। কিন্ডারগার্টেন নামের শিক্ষার ভিন্ন ধারার প্রতিষ্ঠানে শিশুদের কী পড়ানো হচ্ছে এ নিয়ে একটি তদন্ত করেছে জাতীয় নাগরিক কমিশন। গত বছর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে এক ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়েছে যে কিন্ডারগার্টেনের পাঠ্যবইয়ে যা পড়ানো হচ্ছে, সেটা শিশুমনে বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। এ প্রতিবেদনে কিছু উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন ‘অ’-তে ‘অজু করে পাক হও’, ‘আ’-তে ‘আজান শুনে জামাতে যাও’, ‘ই’-তে ‘ইসলাম চায় শান্তি’, ‘ঈ’-তে ‘ঈমান বাড়ায় শক্তি’, ‘এ’-তে ‘এক হও মুসলমান’, ‘ঐ’-তে ‘ঐশী বাণী আল কোরআন’। ফ্রেন্ডস বুক সেন্টার প্রকাশিত ‘হিমেলের বাল্যশিক্ষা’ বইতে এগুলোই শিশুদের শেখানো হচ্ছে। প্রকাশকের ঠিকানা লেখা হয়েছে, ৩৮/২-খ, বাংলাবাজার, ঢাকা। গত বছরের প্রথম দিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর পর পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে নানা মহল থেকে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সরকারের কাছে এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় নির্মূল কমিটি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় নাগরিক কমিশন গঠন করে। এ কমিশন পাঠ্যপুস্তকের বিতর্কিত বিষয় তদন্তের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো বইও পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় শত বছর ধরে প্রচলিত সীতানাথ বসাক প্রণীত বর্ণ পরিচয়ের ‘আদর্শ লিপি’ বইটি সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য বই। এর কোথায়ও সাম্প্রদায়িক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তবে এ বইটি খুব কম প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাজারের বেশির ভাগ বর্ণ পরিচয়ের বই বের হচ্ছে ধর্মীয় শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে। সীতানাথ বসাকের ‘অ’-তে ‘অলি নাচে ফুলে ফুলে’-এর পরিবর্তে লেখা হচ্ছে ‘অজু করে নামাজ পড়ো’। ‘গ’-তে ‘গান শোনা ভালো নয়’ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে শিশুদের কোমল মনে ধর্মীয় অনুভূতি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা স্কুলগুলোকে প্রথমে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এই স্কুলগুলোতে কী পড়ানো হচ্ছে, শিশুদের মননে জঙ্গিবাদের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না তা তদন্তে নির্দিষ্ট কমিশন গঠন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর