রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

মঙ্গা কাটিয়ে উন্নত জীবনের ছোঁয়া

বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ ১

মাহমুদ আজহার ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, উত্তরবঙ্গ থেকে

ক্ষুদ্র চা চাষি আবদুর রহমান। দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার শাড়িয়ালজোতে তার এখন রয়েছে পাঁচ একর জমির চা বাগান। ২০০১ সালেও দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত ছিলেন তিনি। নিজের অল্প জমিতে কৃষি আবাদ করে তার পরিবারের দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছিল না। চাষাবাদ পরিবর্তন করে এক একর জমিতে চা বাগান করেন তিনি। এরপর তার আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি তেঁতুলিয়ার মডেল চা চাষি। শুধু তিনি একাই নন, তার মতো কয়েকশ ক্ষুদ্র চা চাষি এখন সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছেন। শুধু তাই নয়, তাদের অধীনে শত শত বেকার শ্রমিকেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়ায় সবজি চাষি আবদুল জলিল। তিনি আদা, লাউ, শিম, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করে এখন ভাগ্য বদলেছেন। ওই এলাকায় আবদুল মালেক, আলমগীর হোসেন, সিরাজুল ইসলাম দেওয়ানসহ অনেকেই দারিদ্র্য জয় করতে পেরেছেন সবজি চাষ করে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও যাচ্ছে ক্ষুদ্র চাষিদের এসব সবজি। এক সময় রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়কে মানুষজন চিনত মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে। গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। মঙ্গা তাড়াতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে। গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা আর কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বিপুল সংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের ইচ্ছা শক্তি দিয়ে মঙ্গাকে জয় করেছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নত জীবনের ছোঁয়া লেগেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিল্পায়ন হলে এ অঞ্চলে বেকারত্ব যেমন দূর হবে, তেমনি মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেন বলেন, ‘মঙ্গার কলঙ্ক এখন মুছে গেছে। মানুষের আয়ও বেড়েছে। তবে দারিদ্র্য কমানোর মতো এখনো সেই তুলনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। এখনো কুড়িগ্রামের ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলে শিল্পায়ন হলে এ সমস্যা থাকবে না। তেঁতুলিয়ার ভজনপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পঞ্চগড় এলাকায় সবক্ষেত্রেই এখন পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ায় চা চাষ, পাথরকেন্দ্রিক কার্যক্রম ও স্থলবন্দর হওয়ায় মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে বহুগুণে। এখন আর কেউ মঙ্গা বলে গালি দিতে পারে না। এ এলাকার শত শত ছেলে মেয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও পড়াশোনা করে বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সেনিটেশনসহ স্বাস্থ্যেও অনেক সচেতন পঞ্চগড়ের সাধারণ মানুষ।’ রংপুরের দরিদ্রপীড়িত এলাকা গঙ্গাচড়া উপজেলা। তিস্তা তীরবর্তী এ উপজেলার মর্নেয়া ইউনিয়নের আলেমার বাজারের পান দোকানি আলফাজ মিয়া বলেন, ‘আগোত আশ্বিন-কাত্তিক মাসে পেটোত ভাত যায় নাই। এলা একটা সমিতি থাকি ঋণ নিয়া পানের দোকান করতুচি। দুই ছেলে গাজীপুরে গার্মেন্টে কাম করে। সংসারে কোনো অভাব নাই। আল্লাহর রহমতে দিন সুখেই কাটতোচে’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবহমানকাল খেত-খামারই ছিল এ অঞ্চলের কৃষি শ্রমিকের কর্মের একমাত্র ক্ষেত্র। ছিল না বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা। আশ্বিন-কার্তিক মাসে এ অঞ্চলে কোনো ধরনের কাজ থাকত না। মৌসুমি বেকারত্বে বন্ধ হয়ে যেত কৃষি শ্রমিক পরিবারের আয়। মানুষ না খেয়ে থাকতে থাকতে অপুষ্টিতে ভুগত। আর সে সুযোগে চড়া সুদে ঋণ বিতরণ করত মহাজনরা। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি দিশাহারা হয়ে যখন কাজের খোঁজে ঢাকায় রিকশা চালাতে যেতেন, তখনই ঘরে রেখে যাওয়া পরিবারে ঘটত নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আর খেতের ধান কম দামে আগাম বিক্রি করে দিন কাটাত ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা। গত নয় বছরে দিন পাল্টেছে, সঙ্গে অবস্থারও। এ অঞ্চলের মানুষের এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। কাজের সন্ধানে অন্য জেলায়ও যেতে হয় না। নিজের ঘরের পাশেই কাজ করে টাকা উপার্জন করছে তারা। রংপুর জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্র জানায়, জেলায় কৃষি শ্রমিক ও দিনমজুরের সংখ্যা ১৫ লাখ ৯ হাজার ৬৯২ জন। এরা পরের জমিতে এবং মজুর খেটে জীবিকা নির্বাহ করত। আশ্বিন-কার্তিক মাসে অভাবের ফেরে পড়ত তারা। কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য দূর করতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ২০০৮ সালে রংপুর অঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত ব্রি-৩৩, ব্রি-৬২, ব্রি-৫৬, ব্রি-৫৭ ও বিনা-৭ উদ্ভাবন করে। অন্য জাতের ধান ১৪০ থেকে ১৫০ দিনে কাটা সম্ভব হলেও আগাম জাতের ধান মাত্র ১০৫-১১০ দিন সময়ের মধ্যে কাটা যায়। ফলনও হয় একর প্রতি ৬০ থেকে ৭০ মণ। আগাম জাতের ধান কাটার পর ওই জমিতে আবার আগাম আলু ও সবজি চাষ করলে খরচ অনেক কম হয়। স্বল্পমেয়াদি ও অধিক ফলনের কারণে রংপুরের কৃষকেরা আগাম জাতের ধান চাষে ঝুঁকে পড়ে। এখন আশ্বিন-কার্তিক মাসজুড়ে ধান কাটা মাড়াইয়ের কারণে কৃষি শ্রমিকদের কাজের সংকট দূর হয়ে যায়। এ ছাড়া বছরজুড়ে চলছে টিআর, কাবিখা, কাবিটা, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসৃজন কর্মসূচি, ন্যাশনাল সার্ভিসের মাধ্যমে বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান এবং একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচির অব্যাহত থাকায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। ভিজিএফ, ভিজিডি, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। বছরজুড়ে ন্যায্যমূল্যে খোলা বাজারে চাল ও আটা বিক্রি। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ আর অভাব বোধ করছে না। জেলায় অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে সরকারের ভিজিএফ, ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার সুবিধা ভোগ করছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০৪ জন। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন ৬৪৭ জন। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার। এর মধ্যে ঢাকা ও গাজীপুরে গিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে পরিবারের অভাব দূর করছে ১৫ লাখ নারী, পুরুষ এবং যুবক ও যুব মহিলা। এ ছাড়া গড়ে উঠেছে বিপুল সংখ্যক শতরঞ্চি, পাপসসহ বিভিন্ন পণ্যের কুটির শিল্প কারখানা, পোলট্রি, হ্যাচারি ও দুগ্ধ খামার। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ১৪টি পাটকল, বিভিন্ন পণ্যের ছোট-বড় শিল্প কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে ৮ লাখ ৪৩ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম জানান, আগে এ অঞ্চলে আবাদি জমিতে কেউ এক ফসল আবার কেউ দুই ফসল আবাদ করত। কৃষি বিভাগের পরামর্শে এখন একই জমিতে তিন থেকে চার ফসল আবাদ হচ্ছে। ফলে কৃষি শ্রমিকরা সারা বছরই কাজ পাচ্ছে। এ ছাড়া সারা বছর সবজি চাষ, দরিদ্র পরিবারগুলো বাড়ির পতিত জায়গায় সবজি চাষ করে অভাব দূর করছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে অতিদরিদ্রদের দৈনিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অপরদিকে এ অঞ্চলে মঙ্গা জয়ের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ’-এর মাধ্যমে। সংক্ষেপে যাকে ‘সংযোগ’ নামে বেশি চেনে এ অঞ্চলের মানুষ। ১০ বছর মেয়াদি এই কর্মসূচিতে সরকারি কোষাগার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার থেকে মোট খরচ হয়েছে দুই হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় ৮৬ শতাংশ পরিবার দরিদ্র থেকে নিজেদের উত্তরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্স (আইএনএম) ২০১৪ সালে তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার মানুষের আয় বেড়েছে। ২০০৮ সালে এসব জেলার ২৩ শতাংশ পরিবার মঙ্গার সময় তিন বেলা খেতে পারত। ২০১৩ সালে সেটির বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন ৭৪ শতাংশ পরিবার তিন বেলা খেতে পারছে। ২০০৮ সালে এ পাঁচ জেলার একটি পরিবারের বার্ষিক গড় আয় ছিল ৩৫ হাজার ৪০০ টাকা। ২০১৩ সালে সেটি বেড়ে ৭৮ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। ওই পাঁচ জেলায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ দুটোই বেড়েছে। রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, ‘মঙ্গা বিতাড়িত হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। তবে বেকারত্ব দূর হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর যে পরিমাণ শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার কথা ছিল তা হয়নি। এর প্রধান কারণ গ্যাস ও ব্যাংক ঋণের অভাব। আমরা দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের দাবি জানিয়ে আসছি। গ্যাস সরবরাহ এবং স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদান করা হলে শিল্প ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। বেকারত্ব দূর হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর