মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাটে ফিরছে সোনালি সুদিন

আজ জাতীয় পাট দিবস

বিশেষ প্রতিনিধি

পাটে ফিরছে সোনালি সুদিন

বিশ্বব্যাপী পাটের সোনালি সুদিন ফিরে আসছে। পাটপণ্যের জাগরণ শুরু হয়েছে নতুন করে। প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্যের পরিবেশ বিধ্বংসী আগ্রাসন ঠেকাতে পাটের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে বিশ্বের সচেতন মানুষ। ফলে, দেশের এক সময়ের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের কদর বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। মানুষ যত সচেতন হচ্ছে ততই ব্যবহার বাড়ছে পাটের। বাংলাদেশেও সেই হাওয়া লেগেছে। একসময় বাংলাদেশের পাটের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল, ভারত, চীন ও পাকিস্তান। বর্তমানে সেই বাজার বিস্তৃত হয়েছে প্রায় ৬০টি দেশে। নতুন নতুন বাজারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন আর শুধু পাটের বস্তা উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নেই। নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এখন পাট থেকে ২৮৫ ধরনের পাটপণ্য দেশে বিদেশে বিক্রি করে বাংলাদেশ। ১৭টি পণ্য মোড়কজাতে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ বাস্তবায়ন করায় পাটের বস্তার অভ্যন্তরীণ বাজার বেড়েছে কয়েকগুণ। পাট থেকে মিহি কাপড় তৈরির গবেষণায় দেশের বিজ্ঞানীরা অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। পাট পাতার তৈরি চা রপ্তানি শুরু হয়েছে জার্মানিতে। জামালপুরে পাট পাতার চায়ের ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে এক সময়ের বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশি পাট আগের গৌরবের জায়গায় ফিরে আসছে ধীরে ধীরে।

আজ জাতীয় পাট দিবস : সম্ভাবনার এই বাস্তবতায় ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ/পাট পণ্যের বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ মঙ্গলবার দেশে দ্বিতীয় বারের মতো পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় পাট দিবস-২০১৮’। পাটের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার বিকাশ ও হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। আজ সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দিবসের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে ১১টি ক্যাটাগরিতে ১২ জনের হাতে পাট দিবসের পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। জাতীয় পাট দিবস সামনে রেখে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আজ থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাটপণ্যের মেলা, ৭ মার্চ ঢাকা চেম্বার মিলনায়তনে সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উদযাপনে রাজধানীর প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপে আলোকসজ্জা এবং পাটপণ্য দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে।

পাট পণ্যে নতুন উদ্ভাবন : সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরে পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ভালো যাচ্ছে। দিন দিন সেটা বাড়ছে। অনেক দেশ প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার কমিয়ে পাট পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। দেশের পাটপণ্য বিভিন্নভাবে রপ্তানি হচ্ছে। শপিং ব্যাগ ছাড়াও শোকেজ আইটেম হিসেবে পাটের সামগ্রী বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাটের জীবন নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশ পাটের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। শিগগিরই লোনা পানিতেও পাট উৎপাদন করা যাবে। এ ছাড়া পাটের আরও মিহি তন্তু উদ্ভাবনের মাধ্যমে সুতা তৈরির উদ্যোগও শিগগিরই সফল হতে যাচ্ছে।  মানুষ যত সচেতন হচ্ছে ততই ব্যবহার বাড়ছে পাটের। বাংলাদেশেও সেই হাওয়া লেগেছে। পাটকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছে বিশ্বের মানুষ। নতুন নতুন বাজারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। অনেক দেশে ধান সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে পাটের বস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে। পাট পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান প্রোডাক্ট পাটের বস্তা, এশিয়ান ক্লথ-যেগুলো কনস্ট্রাকশন কাজে নিরাপত্তা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইরান, ইরাক, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপিয়ান বিভিন্ন দেশে এগুলোর চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া সিবিসি (কার্পেট বেকিং ক্লথ), কার্পেটের পেছনে পাটের আস্তরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কার্পেটের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে এর ব্যবহারও বাড়ছে। আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ‘সয়েল সেভার’ মাটির ক্ষয় রোধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। রাস্তার মাটি ক্ষয় রোধের কাজে এটি ব্যবহার করছে তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবহার করছে নদীভাঙন রোধে। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সয়েল সেভার ব্যবহার করছে। হাতিরঝিল প্রকল্পে রাস্তা করার সময় রাস্তার পাড়ে সয়েল সেভার ব্যবহার করা হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশে উদ্ভাবিত এই পণ্যটি বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ায় দেশের সরকারি পাটকলগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয়টি বন্ধ পাট কল চালু করা হয়েছে। এতে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। বিক্রির শর্ত ভঙ্গ করায় ৭টি পাট ও বস্ত্র মিল ফিরিয়ে (টেক ব্যাক) নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

পাটের বস্তায় বিপ্লব : নির্ধারিত ১৭ পণ্য পরিবহন, বাজারজাত ও মজুতকালে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন করায় দেশে পাটের বস্তার বিপ্লব শুরু হয়েছে। ফলে বিজেএমসি’র পাটকলগুলোতে পাটের বস্তার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এই আইন বাস্তবায়নে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পিয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনে, আলু, আটা, ময়দা ও তুষ-খুদ-কুঁড়া উৎপাদন, বিক্রয় ও বিক্রয় এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। ফলে এসব পণ্য মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহারে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়ন করায় বড় কোনো শাস্তি দেওয়া ছাড়াই সুফল পাওয়া গেছে। এই আইন বাস্তবায়নে আমরা সড়ক, মহাসড়ক এবং পণ্যের উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছি। এদিকে পাটের ব্যবহার বাড়াতে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন-বিজিএমসি’র কাছ থেকে সাড়ে ১০ কোটি বস্তা কিনতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন-বিসিএসএ। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় বিসিএসএ-এর চাহিদা অনুযায়ী বিজিএমসি চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধাপে ধাপে ৪৪৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০ কোটি ৬০ লাখ পাটের বস্তা দেবে। সাম্প্রতিককালে এটি একটি বড় ক্রয় চুক্তি বলে মনে করা হচ্ছে।

রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ : আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে পর্যাপ্ত রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও বিশ্ববাজারে এই খাতের রপ্তানি আয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এখাতে রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে কাঁচাপাট রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৭৮৩ কোটি টাকা। পাট সুতা ও কুণ্ডলী রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা, পাটের বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে ৭৫৮ কোটি টাকা এবং পাটজাত অন্য পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৯৮ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাট পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণে এখনো পিছিয়ে থাকায় পর্যাপ্ত পাট পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। তবে সরকার মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল চালু রয়েছে এবং বেসরকারি খাতে প্রায় ২০০ পাটকল রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বেনিন, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, চীন, কংগো, কোস্টারিকা, মিসর, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, জার্মানি, গুয়েতেমালা, হাইতি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, ইরান, জাপান, জর্দান, কোরিয়া, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সৌদি আরব, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, তাজাকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, উগান্ডা, উজবেকিস্তান ও ভিয়েতনামে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর