পঞ্চগড়ে এক সময়ের খরস্রোতা নদী করতোয়া। এখন শুধুই ধু-ধু বালুচর। নদীতে পানি নেই বললেই চলে। বড় অংশ জুড়েই চলছে নানা চাষাবাদ। এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট বড় ৩৩টি নদী। সবগুলোরই প্রায় একই দশা। উৎসমুখে ভারত বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করায় এসব নদ-নদী মরে গেছে। এসব নদীর বুকে জেগে উঠেছে বালুচর। পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর বুকে স্থানীয় কৃষকেরা নানা আবাদ করেছেন। বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে মাছ। পুরো রংপুর বিভাগের ৮টি জেলায় অন্তত ১০০ নদ-নদী রয়েছে। নদীগুলো খনন না করায় বর্ষা মৌসুমে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ বন্যা। আবার দখল-দূষণেও নদীগুলোর বেহাল দশা। যেন দেখার কেউ নেই। নাব্য হারিয়ে প্রমত্তা তিস্তার ভরা যৌবন আর নেই। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠলেও তিস্তা এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে নদীর দেড়শ কিলোমিটার এলাকা এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। যৌবনহারা তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। যতদূর চোখ যায়, শুধু ধু-ধু বালুচর। তিস্তার বুক চিরে এখন নৌকার পরিবর্তে নানান রকমের যানবাহন চলাচল করছে। চরে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হচ্ছে। শুকনো বালুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে সদ্য নির্মিত দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু। যেটি এখনো উদ্বোধনই করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরী এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর করুণ দশার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের যদি বাঁচতে হয় আর দেশকে বাঁচাতে হয়, তাহলে সবার আগে বাঁচাতে হবে নদীকে। নদ-নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ না থাকলে দেশ বাঁচবে না। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
জানা যায়, অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ। নিয়মিত ড্রেজিং ও সংস্কার না করার কারণেই নদীগুলো শীর্ণদশা থেকে ধীরে ধীরে মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে বলে পানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। নদীগুলো মরে যাওয়ার কারণে সেচভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। শুকনো নদীগুলো চলে যাচ্ছে অবৈধ দখলে। সেখানে গড়ে উঠছে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্রহ্মপুত্র. যমুনা, তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, বুল্লাই, টেপা, ধুম, ইছামতি, বুড়িঘরা, আখিরা, যমুনেশ্বরী, চাড়ার কাটা, দেওনাই, ঘাঘট, করতোয়া, ছাইজান, কুমলাই, চিকন, খরখড়িয়া, দুধকমল, ধরলা, ফুলকুমর, সানিয়াজান, মানাস, জিঞ্জিরা, বাঙালী, আত্রাই, কাটাখালি, ইছামতি, পুনর্ভবা, ডাহুক, যমুনেশ্বরী। ভারত থেকে আসা পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া, মহানন্দা, চাওয়াই, করুম, তালমা, পাম, ডাহুক, গোবরা, বেরং, ছোট যমুনা, ছেতনাই, পেটকি, ঘোড়ামারা, মরাতিস্তা, সুঁই নদী, তীরনই, রণচন্ডি, টাঙ্গন, পাথরাজ, ভেরসা, আত্রাই, পাংগা, পাথরাজ, শাও, নাগর নদী প্রভৃতি। কার্যত, উজানে এসব নদীতে ভারতীয় অংশে বাঁধ বা স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে নদীগুলো জীর্ণ হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তার বুক জুড়ে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ চর দখল করে তামাক ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের উৎসব চলছে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার বুকেও অসংখ্য ছোট বড় চর জেগে ওঠায় প্রচুর ছোট ছোট শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন অচল হয়ে পড়েছে, তেমনি নদী তীরবর্তী ফসলি জমি সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু কৃষি অর্থনীতিই নয়, ভূপ্রকৃতির পরিবেশ আজ হমকির সম্মুখীন। ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। গাছপালা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি হয়ে উঠছে রুক্ষ। তবে ভয়াবহ সংবাদ হচ্ছে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে প্রমত্তা তিস্তা নদী ধীরে ধীরে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। তিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে আত্রাই, করতোয়া ও পুনর্ভবার ওপর। তিস্তার শাখা নদী বাঙালী, ঘাঘট, বুড়ি তিস্তা ও পীরগাছার ডোরাকুড়া এখন শুকিয়ে গেছে। ড্রেজিং না করার কারণে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নাব্য সংকটের মুখে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে নৌচলাচল। বন্ধ হয়ে গেছে ছোট-বড় ৭৫টি খেয়াঘাট। ইতিমধ্যে রংপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বুল্লাই, টেপা, ধুম ও ইছামতি নদী। রংপুর পাউবোর পানি বিজ্ঞান শাখার (হাইড্রোলজি বিভাগ) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ বলেন, ‘দেশের নদ নদীগুলোতে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন (৫৫২ লাখ ঘনমিটার) পলি-বালি জমে। নদ নদীগুলোকে ব্যবহার উপযোগী রাখতে হলে প্রতি বছর ৫১৮ ঘনমিটার পলি-বালি ড্রেজিং করা দরকার। করা হয় মাত্র ৯০ লাখ ঘনমিটারের মতো। কিন্তু গত ৪৭ বছরে এ অঞ্চলের কোনো নদ-নদীতে ড্রেজিং করা হয়নি।’ তিস্তার এ মরণদশার ফলে তিস্তা সংযুক্ত ঘাঘট নদ, বুড়ি তিস্তা, আলই কুমারী, বুড়াইল, খোকসা ঘাঘট, আখিরা নদীর অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে রংপুরের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বুল্লাই, টেপা, ধুম ও ইছামতি নদী। তিস্তার এই মরণদশার কারণ সম্পর্কে পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিস্তায় পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। এ ছাড়া নিয়মিত ড্রেজিং না করার কারণে তিস্তায় পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমের অনেক আগেই তিস্তা পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবিলম্বে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা না হলে তিস্তা পুরোপুরি মরে যাবে। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। ভয়াবহ মরু প্রক্রিয়ার কবলে পড়বে রংপুর অঞ্চল।পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তাকে উত্তরের জীবনরেখা বলা হয়। বছরজুড়ে তিস্তায় অথৈ পানি থাকত। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের উজানে ভারত গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে তিস্তার গতিকে থামিয়ে দেয়। এ নদীর মূল স্রোতধারাকে ব্যারাজের বিভিন্ন ক্যানেলের মাধ্যমে ঘুরিয়ে তারা তাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে নিয়ে যায়। ২০১৩ সালে ভারত আরও একটি ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। এরপর গজলডোবা ব্যারাজ থেকে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি ভাটিতে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়, তা প্রায় ৭০ কিলোমিটার অতিক্রম করে তিস্তা ব্যারাজে এসে যখন পৌঁছে তখন নদীর স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে সরু ফিতার আকার ধারণ করে। তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ এই পানিই আবার ব্যারাজের গেট বন্ধ করে ঘুরিয়ে দেয় তাদের মূল সেচ খালের জল সংরক্ষণস্থলে। তারপর ব্যারাজের গেট খুলে মাঝে মাঝে যে পানি দেওয়া হয় তা দিয়ে নদীর বুক ভেজে না। ৮৫০ মিটার প্রস্থ তিস্তায় এখন ৪০ মিটার সরু খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এই ৪০ মিটারের মধ্যে কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমড় পানি। দিনাজপুর জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ইছামতি, গর্ভেশ্বর, পুনর্ভবা, আত্রাই, ঢেপা, ছোট যমুনাসহ প্রায় ১৮টি নদ-নদী। জেলার বিভিন্ন উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা এই নদীগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। এসব নদীর বুক চিরে এখন আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। গড়ে উঠেছে, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, হাট-বাজার, ক্লাব-সমিতিসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সেই সঙ্গে মানচিত্র হতে হারিয়ে যেতে বসেছে নদীর নামও। শুধু তাই নয়, জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় খরা মৌসুমে খাবার পানি বা জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ ফুট মাটির নিচে পাম্প স্থাপন করে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া নদীগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ না থাকলেও নদী দখলকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা অঘটন। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত থাকলেও খরা মৌসুমে রূপ নেয় ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠে।