শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অপরাধমুক্ত এলাকা

যশোর সীমান্তের পুটখালী দৌলতপুর সীমান্ত ও ভারতের কাল্যাণী ও গুনারমঠ ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার ক্রাইম ফ্রি জোন ঘোষণা বিজিবি-বিএসএফের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ সফল হলে অনুকরণীয় মডেল হবে বিশ্বে

বেনাপোল (যশোর) ও কলকাতা প্রতিনিধি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অপরাধমুক্ত এলাকা

গতকাল যশোর সীমান্তে ৮ কিলোমিটার ক্রাইম ফ্রি জোন ঘোষণার পর বিজিবির মহাপরিচালক মে. জে. আবুল হোসেন ও বিএসএফের মহাপরিচালক কে কে শর্মা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রথমবারের মতো সীমান্তের ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার এলাকাকে ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ বা অপরাধমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ-ভারত। বাংলাদেশের যশোর সীমান্তের পুটখালী ও দৌলতপুর বিওপির আওতাধীন সীমান্ত এবং বিপরীত দিকে ভারতের কাল্যাণী ও গুনারমঠ বিওপির আওতাধীন এলাকার সীমান্তকে ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ। এই ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্যে চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার, মানব পাচার, মাদক, অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচারের মতো কোনো আন্তসীমান্ত অপরাধসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে যৌথভাবে লড়াই চালানোর উদ্দেশে নতুন ধরনের এই উদ্যোগ নিল প্রতিবেশী দুই দেশ। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারিরও ঘোষণা দিয়েছে বিজিবি ও বিএসএফ। পাশাপাশি সীমান্ত অপরাধে জড়িতদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা থাকছে দুই দেশেই। পরীক্ষামূলক এই উদ্যোগ সফল হলে বাংলাদেশ ও ভারতের চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই এর আওতায় আনার চিন্তা করছে দুই দেশ। গতকাল দুপুরে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁও সীমান্তে ৬৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কাল্যাণী বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি)-তে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘অপরাধমুক্ত এলাকা’র উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ও বিএসএফের মহাপরিচালক কে কে শর্মাসহ দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তা, যশোর-১ আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রমুখ। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটি বেনাপোল-পেট্রাপোল আইসিপি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বিজিবি প্রতিনিধি দলটিকে স্বাগত জানান বিএসএফ ডিজি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দুই বাহিনীর মহাপরিচালকরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিদর্শন করেন। আন্তর্জাতিক সীমান্তে যৌথ টহল নিয়েও আলোচনা করেন তারা।

পরে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বলেন, চোরাকারবারিরা বিজিবি ও বিএসএফের কমন শত্রু। তাই তাদের প্রতিরোধের লড়াইও হবে যৌথভাবে। আমরা এই ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার জায়গাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখব এবং কোনো নাশকতা দেখলে তা শনাক্তকরণের পর প্রতিরোধ করব। এ জন্য আমরা দুই সীমান্ত বাহিনী একযোগে কাজ করব। কারণ দুজনে মিলে কাজ করলে তার শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। সীমান্ত বরাবর যে কোনো ধরনের অপরাধকে দূর করতে আমরা চেষ্টা করব। এই কাজে সীমান্তে বসবাসকারী দুই পাড়ের মানুষকেও বোঝানোর কাজ করা হবে। একইসঙ্গে সীমান্তপাড়ের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিএসএফের মতো সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, এনজিওর সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। তিনি বলেন, খুব শিগগির সীমান্তের এই এলাকায় একটি ‘ড্রোন’ মোতায়েন করা হবে, যাতে এক জায়গায় বসেই গোটা অঞ্চলটা পর্যবেক্ষণ করা যায়’। সীমান্তের এই অঞ্চলে প্রকল্পটি সফল হলে গোটা বাংলাদেশ সীমান্তেই এই কৌশল অবলম্বন করা হবে বলেও জানান তিনি। তিনি আশা করেন, সারা বিশ্ব আমাদের এই মডেলকে অনুসরণ করবে। পর্যায়ক্রমে সীমান্তের অন্যান্য এলাকায় এরকম ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ প্রতিষ্ঠায় বিজিবি ও বিএসএফ সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিএসএফ ডিজি কে কে শর্মা বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। আমরা চাই সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হোক। তাই এই নতুন কনসেপ্ট কাজে লাগানো হচ্ছে। আমরা দুই বাহিনীই একে অপরকে সহায়তা করব। তিনি আরও জানান, এই ধরনের নাশকতা ঠেকাতে সীমান্তে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, এনজিওকে একত্রে কাজে লাগানো হবে। পাশাপাশি সেসব মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে এনে কর্মসংস্থানের যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চোরাচালানের জন্য পুটখালী একটি কুখ্যাত এলাকা। যদি ওই এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়, তাহলে চোরাকারবারিরা আরও উওরে গাতীপাড়া সীমান্ত ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের দৌলতপুরের স্থানীয় বাসিন্দা আতাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, অপরাধমুক্ত এলাকা ঘোষণা করায় নজরদারি বাড়বে, তা সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের জন্যই ভালো হবে। ভারতের অংশের কালিয়ানি গ্রামের বাসিন্দা অমিত মণ্ডল বলেন, তাদের সরকার ইতিমধ্যে সীমান্তবাসীদের জন্য ১০০ দিনের কাজের একটি প্রকল্প শুরু করেছে। সেখানে প্রতিদিন কাজের জন্য একজন ১৪১ রুপি পান। সীমান্তবর্তী গ্রামের দরিদ্র মানুষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারলে সীমান্ত অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। জানা যায়, ২০১৭ সালের অক্টোবরে ভারতের নয়াদিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ ঘোষণার প্রস্তাব তোলেন বিজিবি মহাপরিচালক। বিএসএফ মহাপরিচালক ওই প্রস্তাবে সমর্থন দেন এবং বাংলাদেশের যশোর সীমান্তের পুটখালী ও দৌলতপুর বিওপি এর আওতাধীন সীমান্ত এবং বিপরীত দিকে ভারতের কাল্যাণী ও গুনারমঠ বিওপির আওতাধীন এলাকার মোট ৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার সীমান্ত পরীক্ষামূলকভাবে ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে অপরাধ বন্ধে ইতিমধ্যে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, সার্চ লাইট, থার্মাল ইমেজারসহ বিভিন্ন নজরদারি প্রযুক্তি বসিয়েছে বিজিবি। পাশাপাশি সীমান্তে অপরাধ প্রতিরোধে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর