মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
দুই সমঝোতা স্বাক্ষর

মিয়ানমারকে বোঝাতে সিঙ্গাপুরের প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রতিদিন ডেস্ক

মিয়ানমারকে বোঝাতে সিঙ্গাপুরের প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন —এএফপি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী মিয়ানমারের নাগরিকদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে সে দেশকে বোঝাতে সিঙ্গাপুরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আসিয়ানের সভাপতি এই রাষ্ট্রকে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। খবর বাসস’র।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু আসিয়ানের সভাপতি রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর তারা যেন মিয়ানমার সরকারকে বোঝায়। এদের (বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের) ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যেই ওই এলাকার স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নির্ভর করছে।’ সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন এবং রাষ্ট্রপতি ও  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইস্তানায় দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এ সময় প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং সিঙ্গাপুরে জাহাজ ভেড়ার পর নাবিকদের ওঠা-নামা নিয়ে সমস্যাটি আলোচনায় প্রাধান্য পায়। তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয় নিয়েও আলাপ হয়েছে।’ এর আগে শেখ হাসিনা ইস্তানায় সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে বলেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গারা আমাদের ওপর বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আলাপ-আলোচনা করে এদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনে সিঙ্গাপুরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন, বলেন পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, দুই নেতার আলোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, সিঙ্গাপুর এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ। এ ব্যাপারেই বেশি আলোচনা হয়েছে। মো. শহীদুল হক বলেন, একই সঙ্গে কানেকটিভিটি বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপরও তাঁরা আলাপ করেছেন এবং সমুদ্রগামী নাবিকদের জাহাজ নোঙরের পর সিঙ্গাপুর বন্দরে ওঠা-নামায় যে সমস্যা হয় সেই বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুব এবং প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দুই দেশের সুবিধাজনক সময়ে এই সফর আয়োজনের বিষয়ে সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন বলেও পররাষ্ট্র সচিব জানান।

শহীদুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে সব খাতে সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ আহ্বান করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য ও মত্স্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং জ্বালানি খাত। সমুদ্রগামী নাবিকদের জাহাজ নোঙরের পর সিঙ্গাপুর বন্দরে ওঠা-নামায় সমস্যাটি সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিঙ্গাপুরকে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক ব্যবধান ঘোচাতে আরও ব্যাপক বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় তার সরকারের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সিঙ্গাপুরের সহযেগিতা কামনা করেন। সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন বলেও পররাষ্ট্র সচিব জানান।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সিঙ্গাপুরে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ প্রদানে সিঙ্গাপুর সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ইস্তানায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের দেওয়া এক মধ্যাহ্ন ভোজে তিনি এই আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে শ্রমিকদের জন্য সিঙ্গাপুর ক্রমশই একটি অন্যতম পছন্দনীয় গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে। আমি আশাকরি, সিঙ্গাপুর এই শ্রমিকদের জন্য বরাবরের মতই সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা অব্যাহত রাখবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এবং সিঙ্গাপুর তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্বেষায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারে। সিঙ্গাপুরের পুঁজি, উন্নত প্রযুক্তি এবং তা ব্যবহারের দক্ষতা রয়েছে। আর আমাদের রয়েছে বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তি, যাদের একটি বড় অংশই বয়সে নবীন এবং শিক্ষিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুরের প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা স্মরণ করে লি সিয়েন বলেন, তখন থেকেই দুই দেশের নেতা, জনগণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্রমশ সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি ২০০৫ সালে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান-আফ্রিকান সামিটে পার্শ্ববৈঠকে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠকের কথাও স্মরণ করেন। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী বলেন, শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বন্ধনের কারণে আমাদের দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২০ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেন এবং ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘যাত্রী’ গ্রন্থে তার প্রতিফলন ও ভ্রমণকাহিনী ফুটে ওঠে।’  এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, তার সংসদীয় এলাকা ইয়ো চু কং রোডে প্রখ্যাত বাঙালি কবির সম্মানে ‘টেগোর এভিনিউ’ নামকরণ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করা অব্যাহত রেখেছে। ‘আমরা আজ দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাহিত্য বিনিময় করতে দেখি’ উল্লেখ করে লি সিয়েন বলেন, ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরের ‘ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বাংলার কণ্ঠ-এর সঙ্গে যৌথভাবে ছয়টি কবিতা সমন্বয়ে ‘এন ইভেনিং অব মাইগ্রেন্ট পয়েট্রি অ্যান্ড মিউজিক-পয়েমস অব মাইগ্রেশন : জয়স অ্যান্ড সরোস’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ করে। লি সিয়েন বলেন, এর মধ্যে জাকির হোসেন খোকন নামে এক বাংলাদেশির ‘পোয়েটিক বায়োগ্রাফি’ রয়েছে, যিনি ২০০৩ সাল থেকে নির্মাণ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন। খোকন বাংলার কণ্ঠের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং তিনি সিঙ্গাপুরে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখে চলেছেন। লি সিয়েন মনে করেন, ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ স্থাপন আমাদের বহুমুখী সম্পর্ককে জোরদার করতে পারে।’ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুংয়ের উপস্থিতিতে উভয় দেশের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সর্বশেষ খবর