মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কেউ ফাইল আটকালে জানান

জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন গোলটেবিল বৈঠকে মন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেউ ফাইল আটকালে জানান

গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

জনশক্তি প্রেরণসংশ্লিষ্ট কোনো ফাইল মন্ত্রীর দফতরে ১০ মিনিটের বেশি আটকে থাকে না বলে জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। তিনি বলেছেন, ‘কেউ বলতে পারবে না আমার কাছে কোনো ফাইল পাস হতে ১০ মিনিটের বেশি লাগে। এ বিষয়ে অন্য কোথাও কোনো কর্মকর্তা অহেতুক জটিলতা তৈরি করলে আমাকে জানান। আমি ফোন করব। আমি দেখব।’ গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত ‘জনশক্তি প্রেরণ : সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সহযোগিতায় এ গোলটেবিলে মন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জনশক্তি রপ্তানিকারক, সরকারি কর্মকর্তা, কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, অভিবাসন বিশ্লেষজ্ঞ, প্রবাসী কর্মীদের অধিকারবিষয়ক সংগঠনের নেতা ও সাবেক অভিবাসীরা। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, যত বেশি পারেন দেশের লোক পাঠান। তাহলেই দেশের মঙ্গল হবে। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এলে দেশ উপকৃত হয়। আর হুন্ডির মাধ্যমে এলে টাকাটা আসে। কিন্তু রেমিট্যান্সটা ওই দেশে থেকে যায়। এতে টাকাটা দেশের কোনো কাজে আসে না। মন্ত্রী বলেন, ‘রেগুলার বেসিসে বিদেশে মানুষ পাঠানো হয়। পাঠানোর আগে কিছু মানুষ আমাদের কাছে আসেন এবং বাকিরা বিমানবন্দর হয়ে সরাসরি বিদেশে যান। আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেলে তাদের ওই দেশের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পারিবারিক অবস্থান এবং দেশে রেমিট্যান্স কীভাবে পাঠানো যাবে সেগুলো জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু কিছু দেশ থেকে নির্যাতনের অভিযোগ আসে। আমরা প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখি। অবশ্য এর অনেকটিই মিথ্যা। তবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব অভিযোগ আমরা পেয়েছি এর অনেকটিই সত্য।’ এ বিষয়ে সৌদি আরবের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের ধনী এসব দেশে আমাদের লাখ লাখ লোক যায়। এদের ওপর বাজার অনেকটাই নির্ভরশীল। এখন আমরা কঠোর হলে তারা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইন থেকে লোক নেয়। তাই নিজেদের সাবধানতা ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা, নানা রকমের বিদ্বেষ, বহির্বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। সমস্যা সমাধানে কোন পদক্ষেপ জরুরি, সে বিষয়ে জোর দিতে হবে। উন্নত বিশ্বে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য কাজ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে হবে সম্ভাবনার এই খাত।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘পেশাদার কূটনীতিক শ্রমিকদের বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না বলে যে অভিযোগ আছে তা অনেকাংশেই সত্য। অবশ্য কূটনীতিকদের নিজেদের পক্ষেও যুক্তি আছে। তার পরও শ্রমিকদের বিষয়ে কাজ করতে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার নিয়োগের আগে শ্রমবাজার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বিদেশ যাওয়া কর্মীদের দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রে নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় চাইলেও বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করা যায় না। কারণ, দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন বলেন, দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখা প্রবাসী কর্মীরা যথাযথ সম্মান পাওয়ার বিপরীতে দেশে আসা-যাওয়ার সময় বরং ভোগান্তির শিকার হন। এটা বন্ধ না করলে দিন দিন রেমিট্যান্স কমবে। ব্যাংকিং সিস্টেম অটোমেশনের পরামর্শ দেন তিনি।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার আতীকুর রহমান বলেন, যে দেশে কর্মী পাঠানো হয় এবং যারা তাদের গ্রহণ করে— এ দুই দেশের মধ্যে আদান-প্রদানে যদি স্বচ্ছতা থাকে তাহলে সংকট কমে যায়। তবে জনশক্তি রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও ব্যাপক ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে বায়রা সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘যারা ব্যবসায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি। প্রশংসা নেই বললেই চলে। ঢালাওভাবে আমাদের ওপর অনেক কিছুই চাপিয়ে দেওয়া হয়।’ জনশক্তি রপ্তানিকে শিল্প ঘোষণার দাবি জানিয়ে বায়রা সভাপতি বলেন, ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বায়রা সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বলেন, বিএমইটির ছাড়পত্র অনলাইনে দেওয়া হলে এ খাতে স্বচ্ছতা আরও বাড়বে। জনশক্তি রপ্তানির টাকা ব্যাংকিং সিস্টেমে এলে মধ্যস্বত্বভোগীদের খপ্পর থেকে রক্ষা পাবেন বিদেশ গমনেচ্ছুরা। বায়রার সাবেক সভাপতি ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নূর আলী বলেন, জনশক্তি রপ্তানির বড় বাজারগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে। গার্মেন্ট সেক্টরের মতো জনশক্তি খাতেও বিশ্বে বাংলাদেশের কর্মীদের বিষয়ে প্রচার চালাতে মন্ত্রণালয়কে আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।

জনশক্তি রপ্তানিকারক, বিতার্কিক ও টিভি উপস্থাপক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় ও বায়রার মধ্যে একটি যৌথ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে চাহিদাপত্র সত্যায়নে দূতাবাসগুলোর আন্তরিকতার অভাবের দিকে ইঙ্গিত করে দূতাবাসগুলোকে আরও সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খরচ লাগে বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশি কর্মীদের আয় সবচেয়ে কম। মাইগ্রেশন খরচ সবার আগে কমাতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ কর্মী তৈরি করার পাশাপাশি দূতাবাসগুলোতেও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের ওপর জোর দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, একটা দেশ যদি তার নিজের নাগরিকদের সম্মান না দেয় তাহলে অন্য দেশ কেন তাদের সম্মান দেবে। অধিকার কর্মী সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, অভিবাসনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে মনিটরিং এখনো অনেকটাই দুর্বল। বিদেশে নিয়োগদাতারা বিভিন্ন সময়ই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হচ্ছেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা, বায়রার যুগ্মসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা, ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টস-ওআরবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রবাসী কর্মী সৈয়দ শামসুল হক, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহম্মদ আলী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর