মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আগুনে পুড়ল চার হাজার ঘর

নিঃস্ব ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগুনে পুড়ল চার হাজার ঘর

মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে একটি বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এমনই এক বস্তিবাসী নারী দীর্ঘদিনের আবাসস্থলের অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে চার হাজার ঘর। নিঃস্ব হয়েছে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। ঘুমন্ত বস্তিবাসী আগুনের আঁচ টের পাওয়ার আগেই লেলিহান শিখায় লণ্ডভণ্ড করে দিতে থাকে সবকিছু। রবিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ২১টি ইউনিটের সহযোগিতায় প্রায় ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুন লাগার কারণ জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে তিনদিক থেকে আগুন লাগায় বস্তিবাসীর অভিযোগ এটি পরিকল্পিত আগুন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা। এ ঘটনায় দগ্ধ বৃদ্ধা জামেলা খাতুনকে (৬৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি জানান, নাতি মজনুকে (১১) নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেন এবং ওই বস্তির একটি ঘরে থাকেন। রবিবার রাতে মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে দেখেন তার ঘরে আগুন জ্বলছে। পরে বের হতে গিয়ে দগ্ধ হন তিনি। চিকিৎসকরা বলছেন, জামেলার ৬৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, রবিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে বস্তির ঝিলপাড় বা ওয়াপদা অংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগার পর মুহূর্তের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। বস্তির বেশির ভাগ লোকজন গার্মেন্টে কাজ করেন। সবার ঘরেই ঝুট এবং প্রচুর পরিমাণে দাহ্য বস্তু ছিল। ফলে আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সরেজমিন দেখা যায়, যাদের ঘর পুড়েছে তারা সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে বিষণ্নভাবে বসে রয়েছেন। অনেকেই ঘরের কোনো মালামাল ছাই হতে অবশিষ্ট আছে কিনা সেগুলো খুঁজছেন। আগুনে কাদের ঘর পুড়েছে সে তালিকায় নাম লেখাতে ব্যস্ত অনেকে। তবে সবারই চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি ও হতাশা। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছেন না তারা। আবার অনেকেই পোড়া জিনিসপত্র বের করে আশপাশের ভাঙ্গারির দোকানে নিচ্ছেন। যারা মালপত্র কিছু বাঁচাতে পেরেছেন, তারা নতুন ঘরের সন্ধানে বের হয়েছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে ঘরহারা মানুষগুলোকে খাবার দিতে দেখা গেছে। বস্তির বাসিন্দা গার্মেন্ট কর্মী আঁখি আক্তার জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুন আগুন চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। চারদিকে শুধু ধোঁয়া উড়ছিল। তাই কিছু না ভেবেই এক বছরের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাই। দূর থেকে তাকিয়ে শুধু ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেন। আগুন নিভে যাওয়ার পর নিজের ঘরের সামনে এসে দেখেন সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। তার মতো অনেকেই জীবন বাঁচাতে ছুটে যান নিরাপদ স্থানে। চোখের সামনে সব ছাই হতে দেখেও তারা ছিলেন নিরুপায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তিনদিক থেকে যেভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আগুন লাগানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। স্থানীয় দোকানি রুমা বেগম জানান, মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙে। ঘর থেকে বের হয়েই দেখি তিনদিকে ধোঁয়া। কেউ আগুন না লাগালে আগুন এভাবে ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। কারণ আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রুমার মতো একই অভিযোগ অন্যদের। তাদের দাবি, নাশকতা করতেই এই ঘটনা। সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, যারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত আমার একটি নির্মাণাধীন মার্কেটের সাতটি ফ্লোরে যাদের ঘর পুড়েছে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ততক্ষণ তারা এখানে থাকবে। আমি তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করব। আগুনের ঘটনা নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা হতে পারে। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শাহিদুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরিতে আমাদের কর্মীরা কাজ করছেন। তালিকার পর প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, আমাদের ২১টি ইউনিট প্রায় ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ক্ষয়ক্ষতি ও আগুন লাগার কারণ জানতে আমার নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— উপ-সহকারী পরিচালক মামুন মাহমুদ ও সিনিয়র স্টেশন (মিরপুর) অফিসার মো. আরেফিন। স্থানীয়রা বলছেন, মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে প্রায় ৭০ বিঘা জমির ওপর চারটি বস্তি ছিল। এগুলো হলো— হারুনাবাদ, কবির মোল্লা, সাত্তার মোল্লা ও নাগর আলী মাতব্বর বস্তি। মূলত এমপি ইলিয়াস মোল্লার বাবা-চাচাদের জমিতে ১৯৭৬ সাল থেকে এই বস্তি গড়ে ওঠে। ৩৫ বছরের পুরনো এ চারটি বস্তিতে ৫ হাজার ঘর ছিল। এখানে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ বাস করত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর