বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলে গেলেন বিজ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র হকিং

প্রতিদিন ডেস্ক

চলে গেলেন বিজ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র হকিং

অপার বিস্ময়ের জগতে পাড়ি জমালেন সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র স্যার স্টিফেন হকিং। যিনি জানিয়েছিলেন বিশ্বের কোনো বস্তুই স্থির নয়, তিনি জানিয়েছিলেন কীভাবে  ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে সময়ের। তিনিই ধারণা দিয়েছিলেন ব্ল্যাক-হোল বা কৃষ্ণগহ্বর আসলে ‘কালো’ নয়। সেখানে সবকিছু শুধু হারিয়ে যায় না, সেখান থেকে প্রতিনিয়ত আলো ও তাপ বেরোচ্ছে। বিজ্ঞানের সব জটিল হিসাবকে যিনি সহজ করে দিয়েছেন। সেই মহান প্রতিভাকে গতকাল ভোরে বিশ্ব হারিয়েছে। ৭৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে নিজের বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর জন্ম আর মৃতুর সঙ্গে জুড়ে রইল বিজ্ঞানের আরও দুই কিংবদন্তি পদার্থবিদের নাম। তাঁর জন্মদিন ৮ জানুয়ারি গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যুদিন। আর যেদিন মারা গেলেন হকিং, সেই ১৪ মার্চ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন। তাঁর সন্তানেরা একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে স্টিফেনের। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু বিশিষ্ট মানুষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। টুইট করেন স্বনামধন্য মহাকাশ গবেষকরা। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ডে জন্ম এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর। ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের প্রতি তাঁর অমোঘ টান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শুরু করেন হকিং। বিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান।

 কিন্তু তাঁর সে সময়ের শিক্ষক বার্মেন জানিয়েছেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হকিং পড়াশোনার ইচ্ছা হারান। কারণ, হকিংয়ের মনে হচ্ছিল, যা তিনি পড়ছেন তা খুবই সহজ। বিশেষ মনোগ্রাহীও নন। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে গিয়ে বিষয়ের প্রতি খানিকটা উৎসাহ ফিরে পান তিনি। তবে ক্লাসে সবচেয়ে মিশুক ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হকিং। গানবাজনা, খেলাধুলো সবেই তাঁর উৎসাহ ছিল। জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন হকিং এবং ঠিক সেই সময়েই মাত্র ২১ বছর বয়সে ধরা পড়ে ভয়াবহ অসুখ মোটর নিউরোন; যা শরীরকে ধীরে ধীরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে। পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই এই রোগ হয়। যাদের হয়, তাদের মাত্র ১০ শতাংশ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন। হকিং সেই বিরল ব্যক্তিত্ব ভয়ানক রোগটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কেবল ৫৬ বছর বেঁচেই ছিলেন না, গবেষণা চালিয়ে গেছেন। এই সময়ের মহাকাশবিজ্ঞানের সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। ব্ল্যাক-হোল নিয়ে নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং নিজেই সেই তত্ত্ব খণ্ডন করেছেন।

‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ স্টিফেন হকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। সেখানে সাধারণভাবে দুই রকমের সময় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। ব্যবহারিক সময় ও মহাজাগতিক সময়। রিলেটিভিটি নিয়ে কম সময়ে এত বড় গবেষণা আর কেউ করেননি। শুধু তাই নয়, স্টিফেন বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান কেবল মুষ্টিমেয় গবেষকের আলোচনার বিষয় নয়। সবার কাছে বিজ্ঞানের আলোচনা পৌঁছে দেওয়া দরকার। ১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিংয়ের ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম ফরম দ্য বিগ-ব্যাং টু ব্ল্যাক-হোলস’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত ১ কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়।

তারকা খ্যাতি : স্টিভেন হকিং দেখান যে কৃষ্ণগহ্বর কীভাবে শক্তি ক্ষয় করতে করতে শূন্যে মিলিয়ে যায়, পরে যা ‘হকিং বিকিরণ’ নামে পরিচিতি পায়। কঠিন গাণিতিক হিসাব ও পরীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে তিনি বিশেষভাবে পরিচিতি পান।

তবে তার থিওরি অব এভরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্ব মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে; যাতে তিনি ধারণা দেন মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই বিবর্তিত হয়।

এই মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হলো— এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম। তিনি বলেন, কবে এর শেষ হবে? কীভাবে শেষ হবে? এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমরা আসলেই ঈশ্বরের মন বুঝতে পারব। আশির দশকের শুরু পর্যন্ত হকিং পেয়েছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরনো অক্সফোর্ডসহ। রানী এলিজাবেথ তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন কমান্ডার হিসেবে। আর ১৯৭৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানায় গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, একসময় যে পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারও এই পদে আসীন হোন তিনি। সর্বশেষ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক ছিলেন।

ঈশ্বরের মন : হকিংয়ের কাছে কেউ যদি জানতে চাইত, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? হকিং বলতেন, ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলির সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছির তত্ত্ব। এই যে হকিং কদিন আগেও বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্ম-হোল প্রভৃতি নিয়ে— এ সবকিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক।

বছর কয়েক আগে হকিং আচমকাই ঘোষণা করেন, সময় ও ব্ল্যাক-হোল নিয়ে তাঁর আগের গবেষণায় অনেক ভুল আছে। ভুল সংশোধনের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। নিজেকেই নিজে ভুল প্রমাণ করে সবাইকে বিস্মিত করেছিলেন হকিং। কারণ, একাডেমিক বিশ্বে খুব কম মানুষই এমন কাজ করতে পেরেছেন।

হয়তো মৃত্যু হলো এই মহান বিজ্ঞানীর। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে। চিরস্মরণীয় হয়ে সবার মধ্যে বেঁচে থাকবেন স্টিফেন হকিং। এএফপি, বিবিসি।

সর্বশেষ খবর