শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ

মাহমুদ আজহার, পঞ্চগড় থেকে ফিরে

বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ

এক যুগ আগেও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর কিংবা রংপুরে পতিত জমির পরিমাণই ছিল বেশি। কোথাও কোথাও এক ফসলি আবাদ হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের চিত্র ভিন্ন। কয়েক বছরেই বদলে গেছে এখানকার চাষাবাদের চিত্র। পরিবর্তন এসেছে জীবনযাত্রার মানেও। এখন জমিগুলোতে আউশ, আমন ও বোরো ধানের আবাদ ছাড়াও চা, কমলা, লিচু, আম, আখ, ভুট্টা, তরমুজ, বাদাম, মরিচ, টমেটো, বেগুন, শিম, করলা, বরবটি, পানসহ নানা প্রকারের রবিশস্য আবাদ হচ্ছে। রংপুরে তামাকের বদলে চাষ হচ্ছে ভুট্টাসহ চার ফসলি আবাদ। তবে ব্যাপক সাফল্য আসছে চা, কমলা, ভুট্টা ও বাদাম চাষে। গড়ে উঠছে মাছ ও দুগ্ধ খামার। বিকশিত হচ্ছে পোলট্রিশিল্পও। উত্তরবঙ্গের শাক-সবজি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কুটিরশিল্পও রংপুর বিভাগজুড়েই। এ ছাড়া পঞ্চগড়ে ভারী শিল্পকারখানাও এখন দৃশ্যমান।

স্থানীয়রা পতিত জমিকে ‘ডাঙ্গি’ বলেন। এসব জমিতে কোনো চাষাবাদই সম্ভব নয় এমন একটি ভুল ধারণারও প্রচলন ছিল। ফলে গরু-ছাগল চারণ ছাড়া কোনো কাজেই আসত না এসব জমি। এখন অধিকাংশ ডাঙ্গি জমিই ভরে গেছে সবুজ চা বাগানে। দুলছে আমন, বোরো ধানের শীষ। প্রযুক্তির ব্যবহার আর কৃষকের সচেতনতার কারণেই এখন এসব জমিতে উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের ফসল। এসব ফসল জেলার মানুষ ভোগ করার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। একসময় রংপুর বিভাগের সাত জেলাকেই মানুষ চিনত ‘মঙ্গাপীড়িত’ এলাকা হিসেবে। গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। মঙ্গা তাড়াতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে। গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা আর কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বিপুলসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মঙ্গা জয় করেছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নত জীবনের ছোঁয়া লেগেছে।

দ্বিগুণ হারে বাড়ছে চা বাগান : পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে প্রতি বছর দ্বিগুণ হারে বাড়ছে চায়ের উৎপাদন। পঞ্চগড় চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় ১৬ হাজার একর জমি চা চাষের উপযোগী। এর মধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মিলে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ করা হয়। দুই জেলায় কম করে ৮টি এস্টেট, ২০টি মাঝারি ও ৪২০টি নিবন্ধিত বাগান রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩ হাজার বাগান। এর মধ্যে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট, স্যালিলেন টি এস্টেট, পঞ্চগড় টি এস্টেট, তেঁতুলিয়া টি এস্টেট, ডাহুক টি এস্টেট, করতোয়া টি এস্টেট ও ময়নাগুড়ি টি এস্টেট উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, গত বছর জেলায় ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৭ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়। প্রক্রিয়াকরণের পর তৈরি চা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২ লাখ ৬ হাজার ৪৬ কেজি। ২০১৭ সালে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ ১ কোটি ৫০ লাখ কেজি কাঁচা পাতা থেকে ৫৪ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদন হয়। তবে পঞ্চগড়ে ভারতীয় বিটি-২৫ ও ২৬ জাতের চা সয়লাব হয়ে যাওয়ায় চায়ের মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। কথা হয় বাংলাদেশ টি বোর্ড পঞ্চগড়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা শামীম আল মামুনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘ভারতীয় চারা বাদ দিয়ে বাংলাদেশি বিটি ২ রোপণ করলে চায়ের মান দার্জিলিংকেও হার মানাবে। এ ছাড়া চা পাতা কর্তনের সময় ৫-৬টি পাতা কর্তন করা হয়। এ ক্ষেত্রে চায়ের মান কমে যায়। এজন্য পঞ্চগড়ের চা মার্কেটে বিক্রি হয় ১৫০ টাকায়, অন্যদিকে সিলেট, চিটাগাংয়ের চা বিক্রি হয় ৫০০ টাকা কেজি দরে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওয়ের পাশাপাশি নীলফামারীতেও শুরু হয়েছে চা চাষ।’

চলতি বছর ৩০ হাজার ১১৪ হেক্টর জমি আবাদ করে কৃষক টমেটো উৎপাদন করেছে ৯৭ হাজার ১৯৩ মেট্রিক টন। এর অধিকাংশ হয়েছে সদর উপজেলায়। ১৭ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে হয়েছে ভুট্টার আবাদ। বোদা উপজেলার অধিকাংশ মানুষ ভুট্টা উৎপাদনে জড়িত। ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে জেলায়। দেশের অর্ধেক বাদামের চাহিদা পূরণ করছে এ জেলার কৃষক। প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করে ১৯ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদন করা হচ্ছে। অন্যদিকে চলতি বছর পঞ্চগড়ের লাল সোনা খ্যাত মরিচ উৎপাদন হয়েছে ১৮ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন; যা আটোয়ারী উপজেলার কৃষক সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ করে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শামছুল হক জানালেন, অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে এই এলাকার কৃষকের। জেলার মাটি ও আবহাওয়া দুটোই কৃষির জন্য উপযোগী। এখানে বহুমাত্রিক চাষাবাদ হয়। প্রায় সব ধরনের ফসল হয়। এ জেলার প্রতিটি বাড়িতেই এখন কমবেশি আম, লিচু, কমলাসহ নানা ফলের গাছ রয়েছে। নিজেদের গাছের ফল খেতে পারছেন তারা। কৃষিকাজ করেই তাদের ভাগ্য বদলে গেছে।

কমলা চাষে উপযোগী পঞ্চগড় : কমলার বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ে। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় শতাধিক বাগান। খেতে সুস্বাদু আর আকারে বড় কমলার আশানুরূপ ফলনে চাষিরা পেয়েছে ব্যাপক সাফল্য। কাঁচা-পাকা কমলা শোভা পাচ্ছে এসব বাগানের গাছে গাছে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে কমলা তুলে বিক্রিও শুরু করেছেন। স্বল্প পরিশ্রমে ভালো ফলন ও ভালো মূল্য পাওয়ায় চাষিরা যেমন লাভবান হচ্ছে তেমন দিন দিন বাড়ছে এ অঞ্চলে কমলা চাষের পরিধি। পঞ্চগড়ের মাটি ও জলবায়ু কমলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানকার কমলা স্বাদে ও গন্ধে ভারতের কমলা বা বাজারের অন্যান্য কমলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ কারণে অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি কৃষক এখন কমলা চাষে এগিয়ে এসেছে। কমলা চাষ করে সচ্ছলতা পেয়েছে এ এলাকার অনেক চাষি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলায় ৭৫ হেক্টর জমিতে কমলার চাষ করা হয়েছে। গড়ে উঠেছে ছোট, বড় ও মাঝারি ধরনের শতাধিক বাগান। কেউবা বাড়ির আঙিনার খোলা জায়গায় কমলার বাগান করেছেন। এসব বাগানে কমলা গাছের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। প্রতিটি গাছে ২০০ থেকে ২৫০টি কমলা ধরেছে। চলতি মৌসুমে পঞ্চগড়ে ৩ হাজার মেট্রিক টন কমলা উৎপাদন হয়েছে; যা গত বছর ছিল ২০০ মেট্রিক টন। নতুন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় কমলা বা লেবুজাতীয় ফল চাষে আগ্রহী চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কমলার চারা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

দক্ষিণ এশিয়ার বড় আম গাছ ঠাকুরগাঁওয়ে! : অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ৩ বিঘা জমিজুড়ে একটি আম গাছ দেখতে দর্শনার্থীর ভিড় জমে যায়। যে কোনো উৎসবের বাড়তি আকর্ষণ এ আম গাছটি। আমও ধরছে নিয়মিত। তাই এ স্থানটির সৌন্দর্যবর্ধন ও সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে প্রশাসনের প্রতি দাবি এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীদের। দূর থেকে দেখে মনে হবে এটি একটি আমবাগান। কাছে গেলে দেখা যায় অকল্পনীয় বিষয়। লতাপাতার মতো আম গাছের ডালপালাগুলো ৩ বিঘা জমিজুড়ে বিরাজমান। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারী এলাকায় আম গাছটি দেখতে শুধু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থী আসেন এমন নয়, দেশের বাইরে থেকেও দেখতে আসছেন। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এত বড় আম গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। দর্শনার্থীদের জন্য স্থানীয় উদ্যোগে কিছুটা সীমানাপ্রাচীর, খাবার পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা হলেও তেমন কিছুই নেই সেখানে। দেশে ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এ গাছটিই সবচেয়ে বড়— এমন দাবি করে গাছটির রক্ষণাবেক্ষণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরা। দিনাজপুরের রসগোল্লা লিচু শীর্ষে : লিচুর রাজ্য হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরে দিন দিন লিচু চাষ বাড়ছে। প্রতি বছর বেড়েই চলেছে লিচু চাষের জমির পরিমাণ। এখন সারা দেশে কমবেশি লিচু চাষ হলেও দিনাজপুরের লিচুর কদর আলাদা। ফাল্গুনের শুরু থেকে দিনাজপুরের লিচুবাগানের গাছে গাছে মুকুলের ম-ম গন্ধে বাগানীরা খুশি। প্রকৃতি ও আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এবারও লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেশের সেরা দিনাজপুরের লিচুর। রসাল ফল লিচু অনেকের কাছে ‘রসগোল্লা’ হিসেবে পরিচিত। গত মৌসুমেও মধুমাসের ফল লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। লিচু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর দিনাজপুরের লিচু দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। লিচুর ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই জেলায় লিচু চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রমতে, গত মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় ৪ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। দিনাজপুরের লিচুর মধ্যে চায়না থ্রি, বেদেনা, বোম্বাই, মাদ্রাজি ও কাঁঠালি উল্লেখয্যেগ্য। দেশি লিচু তো আছেই।এ এলাকায় চা চাষেরও উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ অঞ্চলের অনেকে চা চাষে এগিয়ে আসবে। দিনাজপুরের বিরামপুরের ধানজুড়ির ৩-৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সোনাজুড়ি গ্রামের প্রায় ৯ বিঘা জমির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে আলো-ছায়ায় গড়া মুক্তার হোসেনের চাবাগান। বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ঝলঝলি গ্রামের নজরুল ইসলামের ১ একর জমিতে, শিবরামপুরে ২ একর জমিতে, পলাশবাড়ীতে মাহবুবুর রহমান বুলেটের ১ একর জমিতে ও পাল্টাপুর ইউনিয়নের পাল্টাপুর গ্রামের আশ্রায়ণ কেন্দ্র এলাকায় ১ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। চা চাষ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

রংপুরে তামাকের বদলে ভুট্টা : রংপুরে আগে যে গ্রামের মাঠজুড়ে দেখা যেত তামাক খেত, এখন সেখানে গেলে চোখে পড়ে মাছভরা ধানের খেত। ত্রিফলা ছাড়িয়েও চার ফলা চাষাবাদ চলছে রংপুরজুড়েই। তামাক চাষ কমতে কমতে এ বছর এসেছে মাত্র ৫ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছরও প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। খুব শিগগিরই তামাক চাষ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। তামাকের বদলে ভুট্টা ও আলু চাষের পাশাপাশি নানা ধরনের সবজি ও ত্রিফসলা ধানেই আগ্রহ কৃষকের। কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ার কারণেই মূলত কৃষক তামাক বাদ দিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকছে। মাছ চাষেও আগ্রহ বাড়ছে। শিং, মাগুর, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই, কই, কাতলা, কার্প, সিলভার কার্প ও গ্রাস কার্প, পাঙ্গাশ মাছ তুলনামূলক বেশি লাভজনক।

প্রতিবেদনে তথ্যগত সহায়তা নেওয়া হয়েছে রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর