শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজশাহীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ৭ নদী

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে সাত নদী। শাসনের নামে মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে প্রবহমান এ নদীগুলো। ফলে জেলার ১০টি নদীর মধ্যে মানুষ এরই মধ্যে সাত নদীর নাম ভুলতে বসেছেন। দখল-বেদখলে রাজশাহীর ভৌগোলিক মানচিত্র থেকে এসব নদীর চিহ্ন মুছে যাচ্ছে। কিন্তু নদীগুলো দখলমুক্ত করতে বা এর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কেউ কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।

শুষ্ক মৌসুম এলেই শুরু হচ্ছে পানির সংকট। দীর্ঘ সময় ধরে ভারি বর্ষণ না হওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে দেখা দিয়েছে তীব্র খরা। তীব্র খরায় এখনই এ অঞ্চলের প্রধান ১৩ নদীর মধ্যে ১১টির তলদেশ পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পুকুর, খাল-বিল মিলিয়ে অর্ধেকেরও বেশি জলাধার শুকিয়ে গেছে। খেতের ফসল পুড়ছে পানির অভাবে। একই সঙ্গে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। হ্যারিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ ‘ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ’তে শাসনের নামে মুছে ফেলা সাতটি নদীর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নদীর অববাহিকার মানুষের জীবনযাত্রা এবং গড়ে ওঠা নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার পরিচয়ও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নদীগুলো হচ্ছে নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমঙ্গলা, দয়া, বারাহী, হোজা ও মুসা খাঁন। সবকটি নদীর উৎসমুখ রাজশাহীতে।

১৯৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পদ্মার তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরীর বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। নদীগুলোর উৎসমুখেও এই গেট বসানো হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে নদীগুলোর উৎসমুখ মরে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নদীর পরিচয় হারিয়ে যায়। মানুষ ভুলে যায় নদীর নাম। বর্তমানে নদীর বামতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় পদ্মার তীরে ব্লক বসিয়ে পাকা করে দেওয়া হয়েছে। এর ভিতরেই ঢাকা পড়ে যায় এক সময়ে প্রমত্তা নদীগুলোর উৎসমুখ।

রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকায় ছিল স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। খরস্রোতা এই নদীটি নগরীর কাজলা-জামালপুর ও নামোভদ্রা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হতো। এই জামালপুর মৌজায় পড়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। রুয়েট ক্যাম্পাসের উত্তর-পূর্ব অংশ এখনো নাওডোবা নামে পরিচিত। কথিত আছে স্বরমঙ্গলা নদী পথে ধনপতি সওদাগর নামের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী তার ছেলের বরযাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। বর্তমান রুয়েট ক্যাম্পসের এই এলাকায় নৌকাডুবিতে ধনপতির সলিল সমাধি হয়েছিল। এখনো এই নিচু জলাভূমিটি খোলা চোখে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি মরা নদীর ধারা। নদীটি রাজশাহীর পবা এলাকার ললিতাহার, ভালুকপুকুর, রামচন্দ্রপুর হয়ে ফলিয়ার বিলে গিয়ে পতিত হয়। এখন নদী বলে এর আর কোনো পরিচয় নেই। বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরীর ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। নগরীর ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর এটি অন্যতম। বারাহী সম্পর্কে প্রথম তথ্যটি পাওয়া যায় উইলিয়াম উইলসন হান্টার রচিত স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায়। নদীটি পবা থানার মহানন্দখালী গ্রামে বারনই নদীতে গিয়ে পড়েছে। উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটির বাকি অংশটুকুও মৃত। এর মোহনায় অপর একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করে নদীর মৃত্যু ডেকে আনা হয়েছে।

দয়া নদীটি স্বরমঙ্গলা নদীর একটি শাখা। স্বরমঙ্গলা উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে বর্তমান রুয়েট এলাকায় প্রবেশের ২০-২৫ গজ পূর্বেই দয়া নামের নদীটি জন্ম নেয়। সেখান থেকেই দয়া উত্তরমুখী হয়েছে। নদীটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়াল বরাবর উত্তরদিকে বয়ে গেছে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম দেয়ালের পাশে তাকালে নদীর রেখা বোঝা যায়। রেললাইনের উত্তর পাশে দয়া নদীর খাতটি এখনো বেশ স্পষ্ট। সমতল থেকে প্রায় চার ফুট গভীর ও প্রায় ২৫ গজ প্রশস্ত এই জলাভূমিতে বছরের ছয় মাস পানি থাকে। জলজ উদ্ভিদও আছে এখানে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি খনন করে এটি একটি পুকুরের আকৃতি তৈরি করেছে। নদীটি রাজশাহীর মেহেরচণ্ডী, খড়খড়ি বাজার, কুখণ্ডী, বামন শিকড়, মল্লিকপুর, তেবাড়িয়া, সারাংপুর হয়ে ঘোলহারিয়া গ্রামে আবার স্বরমঙ্গলার সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্মিলিত প্রবাহ ফলিয়ার বিলে পতিত হয়। ফলিয়ার বিল থেকে স্বরমঙ্গলা এবং দয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহটি হোজা নাম ধারণ করে রাজশাহীর দুর্গাপুর থানার পলাশবাড়ী গ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্বমুখী প্রবাহ পথে তিন কিলোমিটার বয়ে যায়। এরপর উত্তরমুখী হয়ে বর্ধনপুর, চৌপুকুরিয়া, সিঙ্গা, দুর্গাপুর, পানানগর, দমদমা, চকপলাশী, গাঙধোপাপাড়া, গণ্ডগোহালি, গোবিন্দনগর হয়ে পুঠিয়ার কানাইপাড়ার মধ্য দিয়ে মুসা খান নদীতে পতিত হয়েছে। এই নদীর দমদমা থেকে কানাইপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ কিলোমিটার এলাকার প্রবাহ পথটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে বেদখল হয়ে গেছে। গবেষকদের দৃষ্টি দিয়ে না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এককালে এখান দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্তা নদী হোজা। অথচ এই দমদমা ছিল সুলতানি আমলের একটি উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক কেন্দ্র। গোবিন্দনগরে ছিল শ্মশানঘাট। স্থানীয় লোকেরা এখনো মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করলেই শ্মশানের পোড়া কয়লার সন্ধান পেয়ে থাকেন। গাঙধোপাপাড়ার নামটিই নদীর পরিচয় বহন করে।

অথচ নতুন প্রজন্মের কেউ জানে না যে এই ৯ কিলোমিটার এলাকায় নদী ছিল। নারদ ঐতিহাসিক নদ। এর মোট তিনটি প্রবাহ। এর প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এটির উৎপত্তি। শাহাপুর থেকে কাঁটাখালী, কাপাসিয়া, জামিরা, হলিদাগাছী, মৌগাছী, পুঠিয়ার তাতারপুর, বিড়ালদহ, ভাড়রা, কান্দ্রা পীরগাছা হয়ে নাটোরের ভিতর দিয়ে নন্দকুজা নদীতে পড়েছে। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নাটোরের ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহে মিলিত হয়েছে। এই নদীর রাজশাহীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহ পথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ এখনো নদীর আদলে মৃতপ্রায়। নদীর এই অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে দিঘিতে রূপান্তর করে মাছ চাষ করছে। মৌগাছী পূর্বপাড়া গ্রামের আনিসুর রহমান সরকার (৬৬) জানান, তিনি বাবার কাছে শুনেছেন, এটি এই এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য নৌপথ ছিল। মৌগাছী পশ্চিমপাড়া পেরিপাটনির ঘাট নামে একটি খেয়া পারাপারের ঘাট ছিল।

সন্ধ্যা নদী নারদের একটি শাখা। এটির উৎসমুখ পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর বাগিচাপাড়ায়। পুঠিয়ার শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে বাঁশপুকুরিয়া, নন্দনপুর হয়ে কান্তার বিলে পতিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। মুসা খানের উৎসমুখ বড়াল নদ। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রাম থেকে উৎপত্তি লাভ করে নদীটি রাজশাহীর পুঠিয়ার ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া, নাটোরের আগদিঘা ছাতনি হয়ে ত্রিমোহনী নামক স্থানে এসে গদাই নাম ধারণ করে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিশে চলনবিলে পড়েছে। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, এই সাতটি নদীর হাজার হাজার হেক্টর সরকারি খাস জমি এখনো দখলমুক্ত আছে। বেদখল হওয়া জমিগুলো উদ্ধার ও খনন করে বর্ষার পানি ধরে কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব। একই সঙ্গে খুলে দিতে হবে এ নদীগুলোর উৎসমুখ। প্রবাহ ফিরিয়ে দিয়ে নদীগুলো শাসন করা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোকলেছুর রহমান জানান, রাজশাহী পানি বিজ্ঞান উপবিভাগের আওতায় রাজশাহী বিভাগের ১৩টি প্রধান নদীর মধ্যে ১১টি নদীর তলদেশ শুকিয়ে গেছে। এগুলোতে এখন পানির কোনো প্রবাহ নেই। এই নদীগুলো হলো রাজশাহীর বারনই, বাগমারার ফকিরনী, নাটোরের সিংড়ার গুর নদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পাগলা নদী, রহনপুরের পুনর্ভবা নদী, নওগাঁর ছোট যমুনা, নওগাঁর আত্রাই নদী, সারিয়াকান্দির বাঙালি নদী, বগুড়ার করতোয়া, নাগর নদ ও সোনামুখীর তুলসীগঙ্গা নদী। এই নদীগুলো এখন পানিশূন্য। এ ছাড়া সামান্য পানিপ্রবাহ রয়েছে বগুড়ার মথুরাপাড়া দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, রাজশাহীর পদ্মা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীতে। তবে এদের শাখা নদীগুলো শুকিয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর রাজশাহী সার্কেলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী, চাঁপাই, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে প্রায় দেড় লাখ সরকারি নলকূপ এবং প্রায় ১০ লাখ বেসরকারি নলকূপ আছে। এর মধ্যে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় রাজশাহী, চাঁপাই ও নওগাঁর ৭০ শতাংশ ও বাকি ৩ জেলার ৪০ শতাংশ নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে। ২০০৭ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পানির স্তর ছিল ৮৫ ফুট নিচে, ২০০৮ সালে তা ৯০ ফুট নিচে নেমে যায় এবং ২০০৯ সালে ১১০ ফুট নিচে নিমে যায়। গত বছর বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৩০ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর