রবিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকায় ঐতিহ্য-২

চোখজুড়ানো সেই সাদা প্রাসাদ

মাহবুব মমতাজী

চোখজুড়ানো সেই সাদা প্রাসাদ

রোজ গার্ডেন। সামনে শানবাঁধানো পুকুর। সেখানে একঝাঁক হাঁসের সাঁতার খেলা। বাড়িটির মধ্যে আছে বড় একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঘাসে ঢাকা লন। তাতে বসার একটি বেঞ্চ। সাদা মারবেলের ছোট মূর্তি। আশপাশের খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে গরু-মুরগি। বাড়ির পেছন দিকটায় ফুল-ফলের বাগান। আর মাঝখানে ধবধবে সাদা একটি রাজপ্রাসাদ। পুরোটাতে আছে একধরনের গ্রামের আবহ। মনে হবে যেন জমিদারবাড়ি। আসলে এটা গ্রাম বা মফস্বলের কোনো বাড়ির কথা নয়। বলছি পুরান ঢাকার টিকাটুলির ১৩ নম্বর কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনের কথা। স্থানীয়ভাবে হুমায়ূন সাহেবের ছোট ভাইয়ের বাড়ি নামে পরিচিত এটি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই ঐতিহাসিক বাড়িটি চেনেন না। এখান থেকে যাত্রা হয়েছিল আওয়ামী লীগের। আজও সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত আছে সেই সাদা দালানটি। কিন্তু এখন বাড়িটির তেমন জলুস নেই। নেই ব্যস্ততা। শুধুই সুনসান নীরবতা। বাড়ির গেটে সার্বক্ষণিক অলস সময় কাটে তিন নিরাপত্তারক্ষী ও দুজন ম্যানেজারের। বাড়ির সামনের কৃত্রিম ঝরনাটি আগের মতো এখন চালু নেই। প্রাসাদটির প্রধান ফটকের সঙ্গে লাগা মালিকের বসবাসের জন্য দোতলা বাড়ি। বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী বহরুদ্দীন এই প্রতিবেদককে জানান, ‘কোনো সিনেমার শুটিং এখন আর এখানে করতে দেওয়া হয় না। মাঝে মাঝে নাটকের অভিনয়ের অনুমতি দিলেও তা দেওয়া হয় অনেক হিসাব-নিকাশ করে। তবে এটি বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত। এর জন্য ভাড়া আসে প্রায় ৩ লাখ টাকা। প্রাসাদের সামনের ফাঁকা অংশটুকুতে প্যান্ডেল সাজিয়ে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়। প্রতিদিন একবার করে ধোয়ামোছা করে প্রাসাদটি সুরক্ষিত রাখা হয়েছে।’ গত শতকের ত্রিশের দশকে ব্যবসায়ী হৃষীকেশ দাস ২২ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছিলেন এই রোজ গার্ডেন। পরে তিনি বাড়িটি খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশিদের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর আবদুর রশিদের মেজো ছেলে কাজী আবদুর রকিব এর মালিকানা পান। ১৯৯৫ সালে ব্যারিস্টার কাজী আবদুর রকিবের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী লায়লা রকিব বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে উত্তরাধিকারী রকিব-লায়লা দম্পতির তিন সন্তান। এরা হলেন কন্যা রুমানা তাবাসসুম, ছেলে প্রকৌশলী কাজী আহমেদ রাশেদ ও প্রকৌশলী কাজী আহমেদ সাজেদ। বাড়িটির সৌন্দর্য উপভোগের পরিস্থিতি আগের মতো নেই। সহজে খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। চারপাশে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী ভবন। সবকিছুর মধ্যেও টিকে আছে চোখ জুড়ানো সেই সাদা প্রাসাদ। এ বাড়ি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মাহাদি মোর্শেদ এই প্রতিবেদককে জানান, দুর্লভ গোলাপের সংগ্রহের কারণে এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’। এ ছাড়া দীর্ঘদিন বেঙ্গল স্টুডিওর অধীনে সিনেমার শুটিং হতো। তাই ‘বেঙ্গল স্টুডিও’ নামেও পরিচিত ছিল। লায়লার স্বামীর বড় ভাই কাজী মোহাম্মদ আবদুর বশির যাকে ‘হুমায়ূন সাহেব’ নামেও ডাকা হতো, তার নামেও বাড়িটি পরিচিতি পায়। আবার অনেকেই আওয়ামী লীগের জন্মস্থান হিসেবে বাড়িটিকে চেনেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের প্রাথমিক আলোচনা সভা হয় এই বাড়িতে। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও একবার এ বাড়িতে আসেন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি কাজী মোহাম্মদ বশিরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। সাদা একটি গাড়িতে করে সেখানে যান। রোজ গার্ডেন সত্তরের দশকে বেঙ্গল স্টুডিওকে ভাড়া দেওয়া হয়। সে সময় বাড়িটি ছেড়ে আবদুর রকিবের পরিবার পাশেই আরেকটি বাড়িতে ওঠে। এরপর আর ওই প্রাসাদে তারা ফিরে যাননি। বেঙ্গল স্টুডিওকে ভাড়া দেওয়ার পর বাড়িটির অবস্থা করুণ হয়ে যায়। সিনেমার শুটিং, মানুষের হৈচৈ লেগেই থাকত। ১৯৯৩ সালে রোজ গার্ডেনকে তারা ফিরে পান। এরপর অনেকের অনুরোধে কিছু সিনেমার শুটিং করতে দিয়েছিলেন। বাড়িটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন আনিস ও আবু হানিফ নামে দুজন ম্যানেজার। তারা জানান, দর্শনার্থীদের ঢোকার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাড়িতে কেউ যেতে পারেন না। এখানে ম্যাডামের (লায়লা) অনুমতি ছাড়া কাউকে কোনো কিছু করতে দেওয়া হয় না। সরেজমিন জানা যায়, ওই সাদা প্রাসাদটির মাঝের কক্ষটি ফাঁকা। দোতলা এখনো রাজকীয়ভাবে সাজানো। তবে সেখানে সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সংস্কারের পর মায়া ধরেছে বাড়িটির প্রতি। বাড়িটির পেছনে আছে কর্মচারীদের থাকার একটি আবাসিক স্থান। বাগানও আছে। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা থেকে শুরু করে দেশি প্রায় সব ধরনের ফলের গাছ আছে। শীতকালে মাঝে মাঝে খেজুরের রসও পাওয়া যায়। পুকুরে মাছের চাষ হয়। বাড়িটির নাম রোজ গার্ডেন হলেও শীত ছাড়া গোলাপের দেখা মিলবে না। ১৯৮৯ সালে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সংরক্ষণের তালিকাভুক্ত হয়। অধিদফতরের লোকজন মাঝে মাঝে এসে বাড়িটি পরিদর্শন করে যান।

সর্বশেষ খবর