শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

টাঙ্গাইলের নদী অস্তিত্ব সংকটে হচ্ছে চাষাবাদ

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। অথচ অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সব নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১৬তম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।

মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের নদী অস্তিত্ব সংকটে হচ্ছে চাষাবাদ

নদী চর, খাল-বিল, গজারির বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন। এই স্লোগান এখন আর টাঙ্গাইলের জন্য প্রযোজ্য হয় না। কারণ সেই নদী-নালা, খাল-বিল এখন আর নেই। অনেক আগেই টাঙ্গাইল শহর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো ভরাট আর দখলের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। টাঙ্গাইলে সর্ববৃহত যমুনা নদী। এই যমুনা নদীর কয়েকটি শাখা নদী টাঙ্গাইল জেলাশহর ও উপজেলা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। তার মধ্যে ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, বৈরাণ, এলানজানী ও শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা লৌহজং নদী অন্যতম। এই নদীগুলোও আজ ভরাট আর দখল হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। একসময় এই নদ-নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত। এখন শুষ্ক মৌসুমে অনেক জায়গায় নদীর তলদেশে ধান চাষ করা হচ্ছে। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীতে লঞ্চঘাট ছিল। লঞ্চঘাটকে ঘিরেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এখান থেকেই ধলেশ্বরী নদীর পানি আর খাঁটি দুধ দিয়ে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরি হতো। সেই নদীর পানি আর নেই। সেই সুস্বাধু চমচমও আর তৈরি হয় না। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও বাসাইল উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাই নদী ও বংশাই নদী। বাসাইলের লাঙ্গুলিয়া নদী, মধুপুরের টোকনদী, গোপালপুরের বৈরাণ নদী, শহরের বুকচিরে বয়ে গেছে লৌহজং নদী। এক সময় এই নদীগুলো ছিল খরস্রোতা। বংশাই নদীও ছিল প্রমত্তা। মহাজনী নৌকা চলাচল করত। নদী পাড়ের জেলেসহ অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। নদী দখল করে কোথাও পাকা ইমারত, কোথাও ইটভাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি আবাদি জমি বানিয়ে ধান চাষ করা হচ্ছে। লৌহজং যমুনার শাখা নদী। ভূঞাপুর থানা সদরের গাবসাড়া থেকে উৎপন্ন হয়ে থানা সদরের এক কি.মি. উত্তরে পাঁচটিকরীতে ঝিনাই নদীর সঙ্গে মিশে দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখী হয়েছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঢালান শিবপুর থেকে মির্জাপুরের বংশাই নদী পর্যন্ত প্রায় ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লৌহজং নদী। টাঙ্গাইল শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা নদীর দুই পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি। এতে করে লৌহজং নদী দখল হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের দখল হয়ে যাওয়া লৌহজং নদী রক্ষার জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর নদী দখল মুক্ত করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ‘লৌহজং নদী রক্ষা করি—পরিবেশ বান্ধব টাঙ্গাইল গড়ি’ স্লোগান সংবলিত হলুদ গেঞ্জি পরে, ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে নদীর ধারে জমায়েত হয়। হাজার হাজার মানুষ নদীর দখলদার উচ্ছেদ ও অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দিয়ে নদীর খনন কাজ শুরু করেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এতে যোগ দেন। নদীর দুই পাশে উচ্ছেদকৃত জমি উদ্ধার করে রাস্তা নির্মাণসহ নদীর তলদেশ খনন কাজ করা হয়। উদ্ধার হওয়া সেই নদী আবার দখল হতে শুরু করেছে। এদিকে বর্তমান জেলা প্রশাসক আশ্বাস দিয়েছেন—বন্ধ হয়ে যাওয়া খনন কাজ ও নদীর দুই পাশে দখলদারদের উচ্ছেদ করে ৭৬ কিলোমিটার নদী দখলমুক্ত করা হবে।

বংশাই নদী বাসাইল উপজেলার পূর্ব সীমান্ত নির্ধারণী নদী। বংশাই নদী ও ঝিনাই নদীর একটি শাখার সঙ্গে মিলিত হয়ে মির্জাপুর হয়ে, ঢাকার কালিয়াকৈরে দুই ভাগ হয়ে মূল ধারা তুরাগ নামে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়ে ঢাকার মিরপুর হয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়েছে।

ঝিনাই জামালপুরের বাউশী থেকে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা ডানদিকে বেঁকে যমুনার পূর্ব পাশ দিয়ে ভূঞাপুর থানার ৭ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে যোকার চরের কাছে ধলেশ্বরীর উৎসমুখের কাছে মিলিত হয়েছে। অপর শাখা দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে বাসাইল ফুলকী হয়ে বংশী নদীতে পতিত হয়েছে। অন্য অংশ দক্ষিণমুখী হয়ে বাসাইলের ফুলকী-আইসড়া, দেউলী, দাপনাজোর নথখোলা হয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে।

বর্ষাকালে যমুনার পানি আসা মাত্রই ফুঁলেফেপে উঠে বংশাই নদী। মির্জাপুরের হাঁটুভাঙ্গা এলাকায় নদী দখল করে ১০-১৫টিরও বেশি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। বংশাই নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। লাঙ্গুলিয়া নদীর পাড়ের বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি।

 অনেক জায়গায় চলছে মাছ চাষ। বৈরাণ নদী গোপালপুর পৌর শহর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণে ভূঞাপুর উপজেলার পাঁচটিকরিতে ঝিনাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ নদীর অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। পরিবেশ ও নদী গবেষক গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, নদী সচল না থাকলে বিভিন্ন বর্জ্য জমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। নদীগুলো দখলমুক্ত করে সংস্কার না করতে পারলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর